Poem

জাদু বাস্তবতা

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এ গ্রামটায় আগে আমি কখনো আসিনি
তবু মনে হয় যেন, স্বপ্নে আধো জ্যোৎস্নায় সব কিছু
আগে থেকে দেখা
জামরুল গাছের নীচে খাঁটিয়ায় বসা, হুঁকো হাতে
বৃদ্ধটি কে? আমার ঠাকুর্দা নয়!
দুটি নারী পুকুরের দিকে গেল জল সইতে, মুখে
সায়াহ্নের আলো মাখা
শান্তি আর বিন্তি পিসি দু’জনে যমজ বোন, ভুল করে
কত না হেসেছি
নৌকোর মাঝিকে দেখে ফৈজুদ্দিন বলে প্রায় ডেকে
উঠছিলুম আর কি!
রান্নাঘর থেকে পাছ-দুয়োরের দিকে যাচ্ছে মা
ওই তো চেতন স্যাকরা, মার শেষ দু’গাছা সোনার চুড়ি
বন্ধক নিয়েছে কাল রাতে
বাবা নিরুদ্দেশ, তাই ঠাকুর্দা মাঝে মাঝেই হাঁক পাড়েন
কে আসে? কে আসে?
খালধারে অতিকায় বট বৃক্ষটির গর্তে তক্ষকের বাসা
ঠিক সাতবার ডাকে, কোনোদিন সংখ্যাটা ভোলে না
পাট খেতে ফিসফিসানি, ঝুরো বৃষ্টি, দিঘিতে ড়ুবন্ত চাঁদ
সব একই ছবি
গোয়াল ঘরের পাশে মাঝরাতে বোবা কালা প্রেতটিও
খুব যেন চেনা…

আসলে আমার কোনো গ্রাম নেই, কখনো ছিল না
ঠাকুর্দা সবারই থাকে, আমার ছিলেন যিনি, তিনি চোখ
বুজেছেন আমি এই পৃথিবীতে
চোখ মেলবার ঢের আগে
বাবা কেন নিরুদ্দেশ হতে যাবেন, চিরকাল মুখে রক্ত তুলে
তিনি তো করে গেলেন শহরে মাস্টারি
ফৈজুদ্দিন নামে কোনো মাঝিকেই আমি সারাজীবনে দেখিনি
তক্ষকের ডাক? হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার শুনেছি বটে
রাজা-ভাত-খাওয়া ইস্টিশানে
তবু যেন এই গ্রাম, এই যে মাটিতে পা, জলকাদা
এসব আমারই
সবই চেনা দৃশ্য, সব প্রিয় মুখগুলি
ধারালো সত্যের মতো ঝলসে ওঠে আসন্ন সন্ধ্যায়
সকলেরই নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে হয়, তবু গলা বুজে গেছে
চোখ কেন জ্বালা করে, আসে তো আসুক
এ মাটিতে মিশে থাক, অকারণ, অনধিকারীর মতো
আমার দু’-এক ফোটা অশ্রু, লোকে
বলে তো বলুক, সেটা
নিছক ন্যাকামি!

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 170

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts