Poem

যে আমি এককালে দেশকে ভালোবেসে গেয়েছি কত গান
দেশের ডাক শুনে, অথবা না শুনেও, চেয়েছি প্রাণ দিতে
মুঠোয় আমলকী, ব্যাকুল কৈশোর, ভুলেছি জননীকে
দেশই গরিয়সী, স্বপ্ন মাখা রূপ দেখেছি দিকে দিকে
সে আমি ইদানীং আয়না-সম্মুখে বিরলে কথা বলি
শূন্য করতল, পাথর অভিমান, একলা পথ চলি
জন্ম দৈবাৎ, কোথায় কোন্ মাটি, তা কেন দেশ হবে…

[এভাবে লিখতে লিখতে একেবারে অন্তঃস্থলের ক্ষোভ এমনই ফেটে বেরুতে চায় যে মনে হয়, এখন ছন্দমিল দিয়ে লেখা আমার পক্ষে একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। তাই অতি দ্রুত আবার অন্যভাবে লিখতে শুরু করি…]

যে-আমি একসময় কত দেশ দেশ বলে গান গেয়ে গলা ফাটিয়েছি
দেশের ডাক শুনে, আসলে সেরকম কিছু না শুনে
পেছন দিকের ধাক্কায় চেয়েছি প্রাণ
দিতে মুঠোয় ছিল আমলকী, সেই পাগল পাগল কৈশোরে
নিজের মাকেও ভুলে গিয়ে দেশকেই মনে হত গরিয়সী
কত স্বপ্ন দিয়ে গড়া একখানা অপার্থিব প্রতিমা
সেই আমি ইদানীং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে আত্মধিক্কার দিই
খবরের কাগজের ওপর থুথু ফেলতে ইচ্ছে হয়
আকস্মিকতাতেই সকলের জন্ম, যে-কোনও মাটিতে, গাছের মতন
দেশ আবার কী, নিছক ছেলে ভুলোনো রূপকথা
ক্ষমতালিপ্সুরাই পৃথিবীটাকে টুকরো টুকরো করে দেশ বানিয়েছে
সমস্ত সীমান্তগুলিই লোভ আর দম্ভ দিয়ে ঘেরা
স্বদেশবন্দনার কাব্য আর গান শুধু অবোধ, আবেগতাড়িতদের
মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ভাঁওতা
দেশ মানে বন্দিত্ব, দেশ মানে অন্ধ কুসংস্কার
জীবনধারিণী ধরিত্রীর সারা দেহে অনবরত ছুরি মেরে চলেছে
মানবসন্তানেরা!

যে-আমি ঈশ্বর কিংবা দেবলোক অস্বীকার করে এসেছি
প্রথমযৌবন থেকে
স্বর্গ-নরক নস্যাৎ করে ধন্য মনে করেছি শুধু একবারের মতন।
মনুষ্যজন্মকে
মানুষকে মনে করেছি অমৃতের সন্তান
মানুষের জন্য পারস্পরিক হাতে হাত ধরা, বুকের উত্তাপ,
মানুষের জন্য ভালোবাসা
শিশুকে আদর, নারীর সুঘ্রাণ, প্রেমেই স্বার্থক ইহলোক
সেই আমিই এখন মানুষকে ভয় পাই, শিউরে উঠি জনসমষ্টি দেখে
মানুষ কোথায়, পৃথিবী ভরে গেছে ছদ্মবেশী অমানুষে
যারা প্রতিবেশী শিশুকে ছুড়ে দেয় দাউ দাউ আগুনে, তারা মানুষ?
যারা ধর্মের নামে এক হাস্যকর গুজবে মেতে উঠে
রক্তের গঙ্গা বইয়ে দেয়, তারা মানুষ?
যারা নিতান্ত পেশিশক্তিতে নারীকে ধর্ষণ করে, তারপর
খণ্ড খণ্ড করে তাকে কাটে,
তারা মানুষ?
যারা মন্দির, মসজিদ, গির্জা গড়ে তারপর এ ওরটা ভাঙে,
সে তারটা ভাঙে, ছিন্নমুণ্ড দিয়ে ভিত গাঁথে,
তারা কি মানুষ?
যারা এইসব ভাঙাভাঙি আড়চোখে দেখে, হত্যালীলায়
হাততালি দেয়
তারা কি মানুষ?
যারা ধ্বংসের অস্ত্র ছড়ায়, অনবরত ধ্বংসের উস্কানি দিয়ে
নিজের সন্তানদের দুধে ভাতে রাখে আর বিকেলবেলা
কুকুর নিয়ে বেড়াতে যায়,
তারা কি মানুষ?
মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো নাকি পাপ
আমি যে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি, কিছুতেই আঁকড়ে রাখতে পারছি না
এই সব কিছুর জন্য নিজের জন্মটাকেই দায়ী মনে হয়।

যারা আমার পরে জন্মেছে ও জন্মাবে
তাদের জন্য কেমন থাকবে এই পৃথিবীটা? আমি
শেষের দিকে কোনও কৃত্রিম, অবিশ্বাসী
আশাবাদ শোনাতে পারব না
তারা কি পারবে সমস্ত দেশগুলির সীমানা মুছে দিতে
অথবা সমুদ্রগুলি ভরে যাবে রক্তে?
তারা কি সমস্ত ধর্মগুলোকে গু লাগা কাগজের মতন ফেলে দিতে
পারবে আবর্জনায়?
(অথবা একটু ভালো করে বলতে গেলে ধর্মগুলিকে ঠেলে দেবে ইতিহাসে?)
অথবা ধর্মধ্বজীরা আরও বেড়ে উঠবে রক্তবীজের মতন?
ঈশ্বরবিশ্বাসীরা কি তাদের ঈশ্বরকে দাড় করাতে পারবে কাঠগড়ায়?
পরিশ্রমের ফসল সবাই ভাগ করে নেবে, না অনবরত কেড়ে নেবে
অন্যের মুখের অন্ন
তারা লাইব্রেরি পোড়াবে, তাজমহলে গিয়ে গণপেচ্ছাপ করবে
হে অনাগত ভবিষ্যৎ ও পর-প্রজন্ম, তোমাদের জন্য আমরা কিছুই
রেখে যেতে পারলাম না,
ব্যর্থতা ছাড়া!

[অথবা এসবই কি আমার নিজস্ব নৈরাশ্য?
অন্য কোথাও আছে অন্য মানুষ, যারা এই সব কিছু বদলে দেবে?
তারা পারবে, ঠিক পারবে তো? সত্যিই আছে
সেই অন্য মানুষ
আমি কি তাদের দেখে যেতে পারব?]

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 121

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts