Poem

হে সুদীপ্তা মোহিনী আমার

শামসুর রাহমান

কী করে তোমাকে ভুলি? সৌন্দর্যের মতো আছ ব্যেপে
হৃদয়ে আমার।
আমার মন্ময় ঘরে দেখি
তোমার চকিত চাওয়া, হাত নাড়া, হাঁটুতে থুতনি রেখে একা
ব’সে-থাকা, ভাসমান মনখারাপের মেঘমালা
এদিক ওদিক।
তোমার চুলের কালো উদ্দাম প্রান্তরে স্বপ্নবৎ
রৌদ্র আর ছায়ার জেব্রারা ছোটে অবিরাম, দেখি,
সুখের যৌবন ছুঁয়ে ব’সে আছ বিষাদের সঘন শৈশবে।

কখনো নদীর বাঁকে, বনে, দ্বীপে, কখনো পাহাড়ে,
কখনো বা কার্পেটের মতন উপত্যকায় খুঁজেছি তোমার
নিভৃত দৈহিক রেখা। দেখেছি পাথরে, বাদ্যযন্ত্রে
অকস্মাৎ তোমারই প্রতিমা।
পাখি, মাছ কিংবা সুপুরির গাছ, সারি সারি, চোখে
পড়লেই মনে পড়ে তোমার সত্তার দৃশ্যাবলি,
স্বদেশের মুখ আর তোমার সজীব প্রতিকৃতি
অভিন্ন জেনেছি।
স্বদেশে আমার প্রিয়জনদের কেউ কেউ পাগলাগারদে
এখন বইয়ে দিচ্ছে বেলা এলোমেলো
চুলে বিলি কেটে,
নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলে আঙুলের ফাঁকে
ওরা সূর্যোদয় দেখে ওঠে, কেউ কেউ কয়েদখানায়
ব’সে সূর্যাস্তের রঙে দ্যাখে ডুবছে শৌখিন খাট।
তোমার জন্যেই
আমাকে গাইতে হবে গান আজও আগেকার মতো,
করতে হবে জড়ো কবিতার জাগর ভগ্নাংশগুলো,
যেমন প্লাবন চলে গেলে কৃষক কুড়িয়ে নেয় শস্যকণা তার।
তোমার জন্যেই
দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঘরের চৌকাঠ ধরে এই অবেলায়।

যেমন ক্ষুধার্ত লোক চায় ঈষদুষ্ণ স্বাদু রুটি,
যেমন নিঃসঙ্গ অন্ধ চায় চোখের পবিত্র জ্যোতি,
যেমন বিচ্ছিন্ন পাখি চায় মৃতা পক্ষিণীর প্রাণ,
যেমন কর্মিষ্ঠ হাত চায় কাজ প্রহরে প্রহরে,
যেমন বিদেশী চায় পরবাসে নিষ্কণ্টক একটি আশ্রয়,
যেমন বিধ্বস্ত রণক্ষেত্রে ক্লান্ত বিবর্ণ সৈনিক চায় শান্তি,
যেমন ভরাট কোনো স্বপ্ন চায় অনিদ্রার রোগী,
যেমন সাধক চায় সর্বক্ষণ ধ্যানের মুহূর্ত,
আমিও তোমাকে তেম্নি চাই
হে সুদীপ্তা মোহিনী আমার।

তুমি যে আমার অলংকৃত কারাগার
এবং তুমিই
আমার রৌদ্রের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় এক অবাধ প্রান্তর।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 246

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts