Poem

সেই আজনবি

শামসুর রাহমান

কোত্থেকে এলো সে কেউ বলতে পারে না, তাকে ঘিরে ভিড় জমে
সকালবেলার রোদে; কেউ
সম্মুখে এগিয়ে যায়, কিছুটা পেছিয়ে আসে কেউ।
পরস্পর কানাঘুষো চলে, কী সুন্দর কী সুন্দর বলে কেউ,
ফ্যালফ্যাল তাকায় কেউবা।
সবুজ শরীর তার স্নেহজাত সমর্থন পায়নি কখনো
গেরস্তের ঘরে;
বাতাসে সোনালি চুল ওড়ে নিরিবিলি চক্ষুদ্বয় পৃথিবীর
সম্পর্করহিত আর পদযুগ কস্মিনকালেও পাঁকে
ডোবেনি এবং
চিন্তা তার সারসের মতো ওড়ে আকাশে আকাশে, ফুলে ওড়ে,
পাখিদের চোখে চোখে, লতাগুল্মময় চিন্তা তার পাতালের
প্রতিবেশী।

বড়ো বেশি চুপচাপ কান্তিমান যুবা তবুও অস্তিত্ব তার
গীতধারা।
তাকে দেখে বোঝা যায় নিজে-নিজে খুশি থাকা বলে কাকে।
যখন বাড়ায় হাত ভালোবাসা মর্মরিত হয় গাছে গাছে,
মাটিতে কী যেন ফোটে ফুলের মতন, অনেক পায়রা ওড়ে
দুরের রোদ্দুরে।
কেউ তার চুল ছুঁয়ে দ্যাখে, কেউ আঙুল বুলোয় ঝলমলে
সবুজ শরীরে,

এ কোন অতিথি এলো আজনবি-সকলেই ভাবে।
কেউ বা বসাতে চায় বৈঠকখানায় তাকে, ভিতরমহলে’
কেউ নিয়ে যেতে চায়, কেউ তার সখ্য একান্ত কামনা করে
সকল সময়।
আজনবি থাকে তবু বাইরে সর্বদা চুপচাপ, একা-একা,
বলে না কারুর সঙ্গে কোনো কথা, বুঝি নীরবতা
একান্ত আরাধ্য তার। যখন সে হেঁটে যায় প্রতিটি সকাল
আরেক সকাল হয়, রাত্রি ভিন্ন রাত্রি, ফুলের কেয়ারি থেকে
জেগে ওঠে স্বপ্নময় গান, তার সঙ্গে চলে পশুপাখি আর
নক্ষত্রমন্ডল।
জানে না সে হিংসা বলে কাকে, কাকে ক্রোধ কিংবা ঘৃণা;
সর্বদা নিশ্বাসে তার বয়ে যায় ক্লান্তিহীন প্রেমের নিশ্বাস।
সকলেই তাকে চায়, কান্তি দ্যাখে, বিশ্লেষণী বোধ লোপ পায়
তার কাছে গেলে।

এভাবে সময় যায়। কেউ সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে, ভাবে ওরা-
কী করে এমন হয়? এ-ও কি সম্ভব এত ভালো কেউ
আমাদের মধ্যে তার খুঁজবে নিবাস? কেউ কেউ সুকৌশলে-
দারুণ হিংসুক ওরা, বড়ো
বেশি হিংস্র-

রটায় নানান কথা, বলে আমরা ফেরেবে প’ড়ে
একটি নকল স্বপ্নে বন্দী হয়ে আছি, এই আজনবি শুধু
অশুভের বীজ
কৌশলে ছড়াচ্ছে লোকালয়ে। একদিন সকলেই সমস্বরে
যেও না যেও না কেউ ওর নজদিক,
বন্দী করো তাকে ব’লে পথে পথে হলো জড়ো, তারপর
খাঁচায় পুরলো সেই কান্তিমান অচেনা যুবাকে।
আজনবি চিত্রবৎ, যেন রক্ত নেই তার শিরার গলিতে,
করেনি সে কোনো প্রতিবাদ।
বড়ো বেশি চুপচাপ খাঁচায় রইলো সে, শুধু তার চক্ষুদ্বয়
তখনো রহস্যময় খুব।

এভাবে সময় যায়। সবুজ শরীর তার ঝলমলে তবু,
নিরিবিলি চক্ষদ্বয় জ্বলজ্বলে।
অকস্মাৎ একদিন কৌতুকের তোড়ে এসে একলেই দ্যাখে
সকালবেলার রোদে দ্যাখে-
শূন্য খাঁচা, কী যেন হিংসার মতো শুধু কালো, অস্থিচর্মসার
পড়ে আছে একরত্তি, মৃত।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 130

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts