Poem

অপরাহ্নে একদল মিউজিসিয়ান

শামসুর রাহমান

অপরাহ্নে একদল মিউজিসিয়ান রকমারি বাদ্য নিয়ে
দাঁড়ায় গলির মাড়ে। যেন গলিতেই কনসার্ট
বিপুল ফুলের মতো পাপড়ি মেলে ভেসে যাবে মেঘে।
অকস্মাৎ একজন ড্রামে নাচায় নিপুণ কাঠি, অন্যজন
বাজায় ক্ল্যারিওনেট, কেউ স্যাক্সেফোন, ভায়োলিনে ছড় টানে কেউ,
কেউবা ট্রাম্পেটে তোলে সুর, শহরের চোখ স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়।
ঘর ছেড়ে লোক
সোৎসাহে বাইরে আসে, মানুষের বাগান সমস্ত গলিপথ।

সমাগত এইসব মিউজিসিয়ান কী রকম খায় দায়, সুখে আছে কিনা,
নাকি অন্তহীন স্বপ্নে ডুবে আছে নিজ নিজ বিশদ গুহায়?
ওরা কি কখনো ছুটি পায়? কে যোগায় ওদের বেতন
কিংবা কোথায় প্রকৃত ডেরা বেঁধে
এখানে এসেছে অপরাহ্নে? করে না এমন প্রশ্ন কেউ, শুধু
শোনে, বাদ্য শোনে!

মিইজসিয়ানগণ শাগালের ছরির মতন-কেউ কেউ
ভাসমান, সঙ্গে ঘোড়া অথবা বাছুর, ভায়োলিন
মালাসহ দোলে, কেউ পথে শোয়ানো লোকের পাশে
দাঁড়িয়ে চাঁদের নিচে ব্যাঞ্জো নিয়ে মাতে, গান গায়!

ড্রাম চায় জ্বলজ্বলে দুই বিঘা জমি,
স্যাক্সোফোন অরণ্যের অন্তর্গত স্বপ্নের প্রপাত,
এবং ক্ল্যারিওনেট চায় যাবতীয় কমলালেবুর
বাগানের একান্ত দখলীস্বত্ব আর
ভায়োলিন চায় স্তব্ধ নদীতীর, কবিতার বর্ণিল টেরেস,
সোনালি ট্রাম্পেট চায় একগুচ্ছ সতেজ গোলাপ,
ব্রাউন গিটার চায় তারে তারে সুন্দরীর ঘুমন্ত শরীর।

তিনটি বিয়ার ক্যান শহরের অনেক ওপরে, প্রায় মেঘমালা
ছুঁয়ে তীব্র মরুঘ্রাণ নিয়ে এ শহরে অবেলায়
কোত্থেকে হঠাৎ এক ভিড় উট এসে মিউজিসিয়ানদের
উদ্ভট ভঙ্গিতে দূরে, বহুদূরে হটাতে হটাতে
খাদের কিনারে নিয়ে যায়।
বিরান প্রান্তর থেকে, খাদের কিনার থেকে ফের
অপরাহ্নে ফিরে আসে একদল মিউজিসিয়ান।

এ-ও কি বিভ্রম নাকি? বাস্তবিকই একদল মিউজিসিয়ান
এসেছে এখানে অপরাহ্নে? কে আমাকে বলে দেবে এই অবেলায়?
আমি তো দেখছি আজরাইল রাশি রাশি ইশতাহার
বিলি করে অলিতে-গলিতে,
চৌরাস্তায়, বাস টার্মিনালে এবং চালান করে কালো চুমো
ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, বেঘোর বস্তিতে।
কতিপয় কফিনের পাশে স্যাক্সোফোন, ট্রাম্পেট, গিটার আর
ভায়োলিন পড়ে আছে। তবে কি সকল স্পন্দমান
মিউজিসিয়ান মৃত? শত শত রক্তমাখা ইঁদুর এখানে
ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ সারাবেলা।
সে কোন মড়কে গেল মুছে জরিগাঁথা ঝলমলে
পোশাক-আশাকে মোড়া টেরিকাটা মিউজিসিয়ান?

ভাবতে ভালোই লাগে
মিউজিসিয়ানগণ এ শহরে সুর তোলে যখন তখন,
ভাবতে ভালোই লাগে,
সেই সুরে এক ঝাঁক কবুতর স্বপ্নের ভগ্নাংশ হয়ে যায়,
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে সূর্যমুখী আর দীপ্র সিংহের সম্প্রীতি
নেচে ওঠে গহন দুপুরে,
সেই সুরে সব বাড়ি হেঁটে যায় কবিতার পঙ্‌ক্তির মতন।

ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে রোগশয্যা উৎসবের দ্বীপ হয় ক্ষিপ্র রূপান্তরে,
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে আফ্রিকার চেয়ে বেশি অন্ধকার আরেক আফ্রিকা
নিমেষেই মৃত্যুহীন আলো-স্নানে মুক্তির মতোই জেগে ওঠে।
ভাবতে ভালোই লাগে
সেই সুরে বড় ক্লান্ত ক্ষুধার্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবিরল ঝরে,
শস্যকণা ঝরে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 178

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts