Poem

উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

শামসুর রাহমান

(আবদূর রাজ্জাক খান বন্ধু বরেষু)

শেষ-হয়ে-আসা অক্টোবরে
শীতের দুপুরে নিউইয়র্কের অরচার্ড স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে
একটি দোকান দেখি মায়াপুরী, দোকানি ওয়াল্ট ডিজনির
আশ্চর্য ডবল, বলা যায়। দিলেন পরিয়ে গায়ে
স্মিত হেসে সহজ নৈপুণ্যে নীল একটি ব্লেজার। ব্লেজারের
বুকে জাগে অরণ্যের গহন শ্যামলপ্রসূ, সরোবর-উদ্ভুত অমর্ত্য
দূরায়নী তান।
সুনীল ব্লেজার ঝুলে আছে
আলনায়, কাঠের হ্যাংগারে একা আমার পুরানো ম্লান ঘরে
মালার্মের কবিতার স্তবকের মতো নিরিবিলি,
অথচ সংগীতময় সর্বক্ষণ অস্তিত্বের পরতে পরতে।
নানান সামগ্রী ঘরে থরে থরে, কিছু এলোমেলো; সামগ্রীর ভিড়ে
সুনীল ব্লেজার যেন বহু গদ্য-লেখকের মাঝে
বড় একা একজন কবি।
ব্লেজারের দিকে চোখ যায়
যখন তখন, দেখি সে আছে নিভৃত অহংকারে,
থাকার আনন্দে আছে, নিজের মতন
আছে; বলে সান্দ্র স্বরে, ‘এই যে এখানে আছি, এই
থাকা জানি নিজেই তাৎপর্যময় খুব’। এ মুহূর্তে
যদি ছুঁই তাকে, তবে মর্মরিত হবে সে এখন, উঠবে জেগে
স্বপ্ন-সুদূরতা থেকে।

কখনো ব্লেজার কৌতূহলে
দ্রুত জেনে নিতে চায় তরুণ রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীকে কখনো
তীব্র চুমো খেয়েছেন কিনা জোড়াসাঁকোর ডাগর অভিজাত
পূর্ণিমায়,
নব্য কবিসংঘ কী পুরাণ নিয়ত নির্মাণ করে মেধার কিরণে আর
শীতার্ত পোল্যান্ড আজ ধর্মঘটে রূদ্ধ কিনা কিংবা কোন
জলাভূমিতে গর্জায়
গেরিলার স্টেনগান, হৃদয়ের মগ্নশিলা, আর্ত চাঁদ
ইত্যাদিও জানা চাই তার।

ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।

কোথায় পাগলাঘণ্টি বাজে
ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা
ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে
এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।
দশদিকে কত রকাডেমিতে নিশীথে
গোর-খোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলি
অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জির মুখ।

গালিবের জোব্বা,
দিল্লির সূর্যাস্ত যেন, রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা অনুপম,
মৌলানা রুমির খিরকা, বোদলেয়ারের মখমলি
কালো কোট দুলে ওঠে আমার সুনীল ব্লেজারের কাছাকাছি।
কিছু অসন্তোষ গাঁথা সুতোয়, বিশদ কারুকাজে;
ইতিহাসবিদ্বেষী ব্লেজার পুণ্য নীল পদ্ম অকস্মাৎ,
অবাধ স্বাতন্ত্র্য চায় ব্যাপক নির্মুখতায় আজ।

নষ্ট হয়ে যাবে
ভেবে মাঝে মাঝে আঁৎকে ওঠে, টুপির মতন ফাঁকা
ভবিষ্যৎ কল্পনায় মূর্ত হয়ে কখনো কখনো,
কবরের অবরুদ্ধ গুহা তাকে চেটেপুটে খাবে
কোনো দিন, ভাবে সে এবং নীল পাখি হয়ে দূর
সিমেট্রির মিশকালো সাইপ্রেস ছেড়ে পলাশের রক্তাভায়
ব’সে গান গায়।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 336

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts