Poem

সুহৃদের প্রতি

শামসুর রাহমান

যেও না ঘাসের কাছে, ইদানীং ঘাস খুব হিংসাপরায়ণ।
যেও না নদীর কাছে, নদী তার ভুলেছে মমতা;
তাণ্ডবের মোহে স্ফীত হয়, তেড়ে আসে
অজগর হয়ে বারংবার, গিলে খায়
ঘর-গেরস্থালি।

যেও না টিলার কাছে, অতিকায় করোটির মতো
টিলা আপনার অভ্যন্তরে নিয়ত লুকিয়ে রাখে ক্রোধ।
যেও না মরুর কাছে, রাশি রাশি বালি
কর্কশ চিৎকারে করে গ্রাস সভ্যতাকে।
অরণ্যের কাছে যাবে? জানো না কি অরণ্য কেমন ভয়ংকর?
এখন তোমার জন্য হাঁ-খোলা পাতাল
জেগে আছে সবখানে। ফুলবাগানের
লতাপাতা অপরূপ লাস্যে জ্বলে উঠে
কখন সাপের ফণা হয়ে যাবে, কিছুতে পাবে না টের তুমি।

থমকে দাঁড়াও কেন হে আমার নিঃসঙ্গ সৃহৃদ?
কেন এত দ্বিধান্বিত নিজস্ব চৌকাঠ ছেড়ে দূরে
যেতে হে বিবাগী পর্যটক? বরং হে বন্ধু তুমি
যাও স্মিত যাও ট্রাউজারের পকেটে
হাত পুরে, শিস দিতে দিতে, যাও মানুষের কাছে।
কখনো বিকেল বেলা আলতো নাড়তে পারো কড়া
কারো দরজায়, কিংবা নিঃশব্দে চেয়ার টেনে নিয়ে
সহজে বসতে পারো চায়ের আসরে।

মানুষের কাছে যাও, নাও মানুষের হৃদয় গোলাপ ঘ্রাণ।
কেন না মানুষ আর হিংস্রতা কখনো
কখনো হাসির খাপে পুরে পূর্ণিমায় চিতাবাঘের মতন
অত্যন্ত উজ্জ্বল হয় সাবলীলভাবে।

এমনকি খুব মন্দ লোকও রমণীকে ভালবেসে
রাত্তিরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, রক্তজবা-পদ্য লেখে
নিষ্করুণ নিদ্রাহীনতায় কুকুরের মাথায় বুলায় হাত,
খেলা করে, শিশুদের খেলাঘরে, বিবর্ণ রোগীকে
সতেজ ফুলের তোড়া উপহার দেয়।
মৃত্যু-ঘেঁষা বিবাদের পরেও মানুষ
সবকিছু ভুলে করে শক্রকে অম্লান আলিঙ্গন।

তবু কেন আজও
কালো অবিশ্বাসের কুণ্ডলী নড়ে ওঠে
বারংবার? কেন মনে হয় প্রত্যেক মানুষ তার
নিজস্ব প্রকৃত মুখ ছিমছাম মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে
পথ হাঁটে, আস্তিনের নিচে রাখে অস্ত্রের বাহার!

যে যাই বলুক, তুমি হে আমার নিঃসঙ্গ সুহৃদ,
মানুষের দিকে উষ্ণ হাত নিয়ত বাড়িয়ে দাও।
তোমার নিকট এলে যে-কোনো অতিথি
যে-কোনো প্রহরে,
‘কেমন, ভালো তো’ বলে তাকে ঘরের ভেতরে, মানে
হৃদয়ের কাছে ডেকে নাও।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 140

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts