Poem

দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি

শামসুর রাহমান

রাত্রির মখমল-আদর গায়ে জড়িয়ে
বসেছিলাম আমার ঘরে। পুরনো চেয়ারের আরাম
রাতের রেশমি অনুরাগের সঙ্গে উড়িত
এক যুগলবন্দিতে। আমার সামনে নগ্নিকার মতো
উন্মোচিত কবিতার খাতার। অনেকদিন পর রাত্তিরে
কবিতা লেখার জন্যে প্রস্তুত করেছি নিজেকে।
কবিতার একটি পঙ্‌ক্তিও লিখে উঠতে পারিনি
এক ঘণ্টার চেষ্টার পরেও। মাথার
পাতলা-হয়ে আসা চুল নিজেকে খুব অসহায়
মনে হচ্ছিল, হঠাৎ পথের কী একটা আওয়াজে
চমকে উঠি। কখন ক্লান্তির আঙুলগুলো আমার
চেতনাকে আস্তে ঠেলে দিল তন্দ্রার চৌহদ্দিতে,
টের পাইনি। কার উপস্থিতির আভায় ঘর
উদ্ভাসিত হলো এবং আমি চোখ কচলে দেখি
আমার টেবিলে হাত রেখে একটু ঝুঁকে
দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি। আলখাল্লা-পরা
অসামান্য ব্যক্তিটি যে রবীন্দ্রনাথ, চিনতে
দেরি হলো না। তিনি আমার কবিতার
খাতার দিকে তাকিয়ে রইলের কিছুক্ষণ।

আমি বিহ্বলতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্তায় সশ্রদ্ধ মুদ্রা। রবীন্দ্রনাথ
আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বসতে বললেন আমাকে।
‘লেখো তুমি, কবির ধ্যানে বিঘ্ন ঘটাতে চাইনে,
তোমার উদ্যমে সাক্ষী হ’তে চাই’-শব্দগুলো তাঁর কণ্ঠে
ঝঙ্কৃত হলো সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের মতো।
‘তিনটি অক্ষরের একটি শব্দের অভাবে আমি
শুরু করতে পারছি না আমার নতুন সনেট’, কোনোমতে
জানাতে পারলাম তাঁকে। কবিগুরু আকাশের সুদূরতায়
দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইলেন আগের ভঙ্গিতেই।

‘নিজেকে অপেক্ষা করতে শেখাও, এই আমি
আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ একটি শব্দের জন্যে অপেক্ষা
করেছি প্রহরের পর প্রহর, দুপুরে কখনো
নরম শয্যায় শয়ন করিনি, পাছে ঘুমিয়ে পড়ে।
তোমরা তো জানো কত শ্রম আমাকে
করতে হয়েছে। সাধনায় যতি পড়েনি বলেই কবিতা
এসেছে আমার কাছে যেমন পাতা আসে গাছে,
মাছের ঝাঁক ভেসে ওঠে জলাশয়ে’- রবীন্দ্রনাথের
উচ্চারণে উৎসাহ-জাগানিয়া সুরের ঢেউ। আমি
তিন অক্ষরের একটি শব্দের জন্যে আবার সতৃষ্ণ হয়ে উঠি
‘তুমি অনেক প্রেমের কবিতা লিখেছ’, কবিগুরু মৃদু হেসে
বললেন, ‘তাই তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই আমার
কাদম্বয়ী বৌঠান যখন বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার
কাছে আমার কবিতাকে তেমন আমল দিতেন না,
তখন, লুকাব না, ঈর্ষার আলপিন বিঁধতো
মর্মমূলে। বৌঠান কি সত্যি আমার জন্যে
আত্মহত্যা করেছিলেন, তুমি ভাব? আমি নিজে
সেই রহস্যে মুখ থেকে কখনো আবরণ সরাতে পারিনি।
শ্রাবণ রাত্রিকে জ্যোতির জোয়ারে ভাসিয়ে তিনি
নিরীক্ষণ করলেন আমার ঘর; অমরতা, তাঁর চিরসঙ্গী, তাঁকে
এগোনোর তাগিদ দেয়। নক্ষত্রের বর্ষণ বনবাণীর প্রতি উদাসীন
তিনি যাত্রা করলেন নিরুদ্দেশে, দিকচিহ্নহীন অনন্তে।

ভ্রমরের গুঞ্জরণের মতো কী একটা সুর বাজতে থাকে
আমার ভিতর, তিনটি অক্ষরের একটি শব্দ
জানলা দিয়ে উড়ে এসে বসলো আমার
কবিতায় খাতায়, শূন্য স্থানে বিদ্যুল্লতা, কেমন ফুলঝুরি।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 117

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts