Poem

এ কেমন লুকোচুরি খেলা

শামসুর রাহমান

এ কেমন লুকোচুরি খেলা নিশিদিন? কখনও সে
সহজেই দেখা দেয়, খুব কাছে এসে বসে, হাত রাখে হাতে,
সুধা ঢালে

ঠোঁটে; চোখে চোখে কী-যে মাধুর্য ছড়ায়
যেন অমরতা দিচ্ছে এঁকে ক্ষয়া অস্তিত্বে আমার।

কখনও ভীষণ মেতে ওঠে অবহেলায়, নির্দয় প্রত্যাখ্যানে-
দূর থেকে চলে যায়। করে না ক্ষণিক দৃক্‌পাত, যেন আমি
বড়ই বেগানা কেউ। জ্যোতিচ্যুত একা পড়ে থাকি গৃহকোণে
চুপচাপ, মাঝে মাঝে করি পায়চারি দিশেহারা
নাবিকের দৃষ্টি নিয়ে। তাকাই কাছের পুষ্পহারা,
বস্তুত দুঃখিত, অতি ম্লান কৃষ্ণচূড়া গাছ, ভাসমান মেঘ,
সন্ধ্যার পাখির দিকে। দেখি গলিপথে একজন ঢ্যাঙা লোক
হেঁটে যায়; কখনওবা কবিতার খাতা খুলে বসি।

একদিন অকস্মাৎ চোখে পড়ে-সেই মায়াবিনী
চলেছে আমাকে ফাঁকি দিয়ে মেঘলোকে
ভেসে ভেসে। ‘এসো, এসো একান্ত আমার কাছে, তোমার
জন্যেই
আমার প্রতীক্ষা জাগে বিলের বকের মতো’ বলে গাড় মিনতি
জানাই।
সে মোহিনী নির্দয় হাসির ঢেউয়ে দুলে বলে, ‘শোনো,
পশ্চিম বঙ্গের কোনও খ্যাত প্রবীণ, নবীন
কবির খাতায় বসে কাটাব সময় কাব্যপঙ্‌ক্তি অকৃপণ
বিলিয়ে এবং বাংলাদেশে কতিপয় অনতিতরুণ আর
তরুণ কবির ঘর ছুঁয়ে কিছু চিত্রকল্প, উপমা, রূপক
না চাইতেই দেব উপহার। আজ তুমি মাথা কুটে মরলেও
পাবে না আমার ছোঁয়া। খাতায় যতই
শব্দ লেখো, হবে সবই নিষ্প্রাণ, অসার খড়কুটো।

সকালের রোদের উল্লাস আর বাউল-দুপুর
আমার হৃদয় ছিঁড়ে নাচে; আমার কুয়াশাময়
মাথার ভেতর কয়েকটি ফড়িঙ হারায় পথ, কিছু সাঁকো
ভেঙে পড়ে, জোনাকিরা পারে না ফোটাতে জ্যোতি এবং
আমার
অন্তর্লোক গুমরে গুমরে ওঠে শব্দহীনতায়, এক-আধটা
পঙ্‌ক্তিও দেয় না ধরা। ঘোর অমাবস্যায়, অগাধ পূর্ণিমায়
নিষ্করুণ কণ্টকিত প্রহর যাপন শুধু আর দেখি কত
স্বপ্ন, মনে পড়ে না কিছুই, সবই হিজিবিজি, ক্রূর।

একটি শিশিরভেজা শেয়ালের রক্তঝরা মুখে, নর্দমায়
পড়ে-থাকা ইঁদুরের মৃত দাঁতে, নুলো ভিখিরির খুব নোংরা
ন্যাকড়ায় পলাতকা মায়াবিনী চোখ রেখে বলে,
‘পারো তো এসব থেকে আমার রূপের উৎসটিকে করো
আবিষ্কার।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 141

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts