Poem

পাশা খেলা

শামসুর রাহমান

দীর্ঘকাল আগে এক পড়ন্ত বেলায়
কে যেন আমাকে আচমকা
ছুঁড়ে দিয়েছিল জাফরানি মেঘের ভেতর।
ভেসে যাচ্ছিলাম কোন্‌ অচিন এলাকায়, তার নাম
বলা অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে। মেঘের বানে
ভিজে যাচ্ছিল আমার সত্তা।

তারপর কী-যে হলো, স্থৈর্যের আঁচলের, আড়াল থেকে
আমাকে বের করার নীরব উৎসবের
উপক্রমণিকার আয়োজন। আমার ভেতর সকালসন্ধ্যা,
এমনকি মধ্যরাতের স্তব্ধতার মুহূর্তেও
প্রবল ছটফটানি। গাছের পাতা, পথের ধুলো,
দমকা হাওয়া আমার সঙ্গে কীসব কথা বলতে শুরু করে।

এরই মধ্যে একদিন দূর থেকে এক অপরূপা রূপসী,
যার চোখে কৌতুকমিশ্রিত নির্দয়তা
খেলা করছে, আমাকে ডেকে বললেন,
‘এসো, আমরা দ্যূতক্রীড়ায় কিছু সময় কাটাই’। আমি যে
এ খেলায় একেবারেই আনাড়ি, তাকে
তোতলাতে তোতলাতে জানালাম।

সেই অনন্তযৌবনা রূপসীর হাতে আশ্চর্য এক বীণা,
পায়ের কাছে অনুপম শাদা হাঁস। তিনি হাসিমুখে
আমার সামনে বিছিয়ে দিলেন পাশা খেলার
সরঞ্জাম। চোখ-ধাঁধানো ছক আর ঘুঁটি দেখে
আমার প্রায় মূর্ছা যাওয়ার হাল। কী করে
খেলবো আমি যে এ খেলার কোনও রীতিনীতিই জানি না!
প্রতিপদে লেজেগেবরে করে ফেলছি, লজ্জায়
কাটা যাচ্ছে মাথা, নিমেষে বারবার
হার মেনে নিতে হচ্ছে ভুল চালহেতু। বহুদূর
থেকে এক জ্যোতির্ময় আস্তানায় বসে হাসছেন
চণ্ডীদাস, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ
এবং আরও কজন। কারও কারও মুখে বেদনার রেখা।

এই পাশা খেলার হারতে হারতে আমার কালো চুল
কবে যে ধবধবে শাদা হয়ে গেল,
মুখের চামড়া গেল ভীষণ কুঁচকে , টেরই
পেলাম না। বুঝতে এতটুকু ভুল হলো না,
সেই নিষ্ঠুরা, অপরূপ রূপসীর হাত থেকে
নিস্তার নেই। পাশা খেলা চলতেই থাকবে
ঘুমে ডুবে না-যাওয়া অব্দি। শেষ খেলার
বিজয় আমার মাথায় চুমো খাবে কিনা, অজানা রয়ে যাবে?

হার জিৎ যা-ই হোক, বিলাপ অথবা উল্লাস
কারও পথে হাঁটবো না। অন্তত
গৌরবের কিছু গুঁড়ো সত্তায় ছিটানো
রয়েছে ভেবে বাইবো বিনীত খেয়া।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 126

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts