Poem

ঋজু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই

শামসুর রাহমান

বলপয়েন্টের ক্যাপ বহুক্ষণ খুলে রেখেও যখন শাদা
কাগজে ফোটাতে শব্দ ব্যর্থ হই, ফের
লেখনীটি বন্ধ করি ক্যাপে। কিছুক্ষণ কেটে গেলে
বলপয়েন্টেকে বন্দিদশা থেকে রেহাইয়ের পর
আবার টেবিলে ঝুঁকে কাগজের বুকে
কিছু আঁকিবুকি কাটি, না-লেখা সম্ভাব্য পঙ্‌ক্তিমালা

আন্ধারে গুমরে মরে। ইচ্ছে হয়, আঙুল কামড়ে ধরি আর
উত্তপ্ত মাথার চুল ছিঁড়ি।

মাঝে মাঝে মনে হয়, খাঁখাঁ কাগজের বুকে নান্দনিক কিছু
কাব্য পঙ্‌ক্তি ফোটাতে না পেরে
চটজল্‌দি নিজেকে সুতীক্ষ্ণ হতাশার গিলোটিনে
হাঁটু গেড়ে বসানো কি এতই জরুরি?

আমরা তো মাঝে মাঝে প্রেমিকার সঙ্গে সাক্ষাতের
জন্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকি, তেমনি কি কবিতার
সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় দীর্ঘকাল
অপেক্ষা করা কি আরও বেশি কাঙ্ক্ষণীয় নয়? যতদূর জানি,
একজন প্রয়াত মহান কবি কবিতা সৃষ্টির গূঢ় রহস্যের
মহাসত্য করেছেন গাঢ় উচ্চারণে, “প্রতীক্ষা শেখাও প্রভু।“

তবে এ রকমও হয়,- দীর্ঘ প্রতীক্ষা সত্ত্বেও কোনও
কোনও কাব্য-প্রয়াসের অপমৃত্যু ঘটে! তবু কবি
সাধনায় টানেন না ছেদ, কবিতা নামের দ্রুত
পলায়নপর হরিণীর পেছনেই ছুটতে থাকেন নিত্য।

কবিতা যদিও মায়াবিনী ব’লে খ্যাত, তবু নয়
একরোখা, বহুমুখী সত্তা তার, এ-কথা সবার
জানা আছে। কখনও সে অপরূপা স্বপ্নময়ী, কখনও বাস্তবে
ঝলমলে; কখনও সওয়ার হয়ে পক্ষীরাজে সাত
আসমানে ওড়ে, কখনও বা রোদে-পোড়া,
বৃষ্টিভেজা মৃত্তিকায় হাঁটে, কখনও বিনম্র স্বরে গান
গায় আর কখনও উজ্জ্বল জনসভায় জোরালো কণ্ঠে গর্জে ওঠে-
আজও আমি তার সব রূপের বন্দনাগীতে সত্যি মজে আছি।

আমার একান্ত সাধনায় তার সন্তোষ সৃষ্টিতে
কতটা সার্থক আমি জানা নেই, তবু আজ অব্দি
রোগ শোকে দগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিছুকেই
প্রমাদক্রমেও উঁচু স্তরে বসাইনি। জয় হোক
কবিতার, মানবের সর্বদা আবৃত্তি ক’রে হিংস্র আঁধারকে
তুচ্ছ ভেবে স্বদেশের মাটিতেই ঋজু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 113

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts