Poem

আমার স্বরের ডালে

শামসুর রাহমান

আমার স্বরের ডালে কুড়ি ধরার দিনগুলি
এখনো জাগিয়ে তোলে আমাকে সমস্ত আচ্ছন্নতা থেকে আর
মনে পড়ে, সেই কুড়ি প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই
অনেকগুলো নোংরা নখ, কালো তারকাঁটার মতো,
ঘিরে ধরলো আমার স্বরের ডালটাকে।
সেদিন থেকে আমার হৃদয় ঝরনার মতো রক্ত ঝরায়,
সেদিন থেকে আমার কণ্ঠস্বর এক তীব্র আর্তনাদ।

লোর্কার মতো শিল্পের আবেগে বাতাসে গোলাপের পাপড়ি হয়ে,
গিটারে গিটারে গুঞ্জরিত গীতিকবিতা হয়ে,
আন্দালুশীর মাল্লাদের গান হয়ে
কেঁপেছি থরোথরো, অথচ তাঁর মতো অজর কবিতা-যে কবিতা
স্পেনের নিশ্বাস হয়ে বয়ে চলেছে আজো পাহাড়ে, সমুদ্রতটে,
রমণীর পুষ্পিত বুকে, পুরুষের কম্পিত ঠোঁটে-
লিখতে পারবো না কোনদিন।

তপ্ত গোলাপের মতো লোর্কার একেকটি কবিতা
আমাকে অন্ধকার থেকে করেছে উদ্ধার, একেকদিন
শুধু কয়েকটি শব্দ কণ্ঠে ধারণ করে, লালন করে ঝাঁঝালো আদরে
কেটে গেছে প্রহরের পর প্রহর,
সেদিন থেকে মৃত্যুকে ঘেন্না করতে শিখেছি আমি।

লোর্কার উচ্চারণে গোলাপের গভীর নাম ধরে ডেকে ডেকে
সুঘ্রাণ করতে চেয়েছি সত্তা। আমার শয্যার বাগানে
যে-পাখি ব্যাকুল এক গান থেকে আরেক গানের দিকে করে যাত্রা,
তার কণ্ঠে গোলাপ-গজলের সুর ধ্বনিত হোক, চেয়েছিলাম।
অথচ আমার সত্তার ডালপালায়
ঝটিতি বয়ে গেল শুধু কনকনে আর্তনাদ।

চোখের পাতায় কিংবা অক্ষি-গোলকের পরপারে
চিরকাল এক স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে
আমি দয়িতাকে আলোয় গলে যেতে দেখেছি।
যতবার সেই গলে-যাওয়া আলো
আঁজলা ভরে পান করার জন্যে অধীর হয়েছি, ততবার
সূর্য ‘আমার পুচ্ছে’
চাঁদ আমার গলায়
তোর কবর বলে চেঁচিয়ে উঠেছে আর
আমার সমস্ত ভালোবাসা আর্তনাদ হয়ে ঝরে গেছে
খুরে খুরে মাটি খুঁড়ে তোলা এক কালো ঘোড়ার পায়ে।
লোর্কার কণ্ঠ ওরা চিরতরে স্তব্ধ করবে ভেবেছিল
কবির রক্তে রাঙিয়ে শূন্য, হাঁ করা প্রান্তর,
কিন্তু ঐ দ্যাখো তাঁর ক্ষত গোলাপের মতো জ্বলছে,
দুলছে কালকণ্ঠে। শৃন্বন্তু অমৃতস্য পুত্রা
লোর্কার কণ্ঠ সেকালের সব পাহাড়, উপত্যকা, আপেলের বন,
প্রান্তর পেরিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে একালে।

মৃত্যুর কালো আলখাল্লায় মুক্তো হয়ে
ঝলমল করছে লোর্কার একেকটি বালাদ, গোলাপের কাসিদা।
আমি কর্ডোভার ঘোড়সওয়ার নই,
দিনের সোনালি ঝরনায় অবগাহন করে হেঁটে যাই
চেনা অচেনা বহু সোজা, বহু ঘোরানো রাস্তায়,
তবু লোর্কার বালাদ মিশে যায়
আমার স্বরের ডাল থেকে ঝরে-পড়া আর্তনাদে।

না, আমরা কেউ সুখী নই।
ভাড়াটে বাচস্পতির বাছা বাছা বাক্য
আমাদের কানের বিবরে গিরগিটি সেজে সুড়সুড়ি দেয় শুধু।
শিশুরা খেলাঘর ছেড়ে গোরস্থাএ যায় বড় বেশি,
মেয়েরা পৃথিবীতে সন্তান আনতে আনতে ফৌত হয়ে যায়,
যুবকেরা সুদিনের চৌকাঠে কখনো পা না রেখেই
একদিন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে গলির মোড়ে, পার্কের ধারে
আর চশমার পুরু কাচ-ঢাকা চোখ দিয়ে
চাটতে থাকে শৈশব-স্মৃতিকে,
যেমন খড়-ঠাসা বাছুরের গা চাটে ধবলী।

ভদ্রমহোদয়গণ,
এই গাছপালাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,
ঘরের এক কোণে-রাখা ভাঙা হারিকেন,

সেজো-অধ্যুষিত গলির কানা বেড়াল
অথবা মেথরপট্রির নেড়ী কুকুরটাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন,
আমরা সুখী নই কেউ।
বিশ্বেস করুন,
এদেশের পোকা-মাকড়, জীবজন্তুগুলোসুদ্ধ ভীষণ অসুখী।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 91

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts