Poem

তিনি সূর্যাস্তের লোক

শামসুর রাহমান

তিনি সূর্যাস্তেরই লোক; অবশ্য অজস্র সূর্যোদয়
সত্তায় রেখেছে জমা অন্তর্লীন আভা, ছড়িয়েছে
প্রাণবীজ পলে পলে তন্তুতে তন্তুতে আন্তরালে,
তবু অস্তরাগ
ডাক দেয় তাঁকে বারবার। এত যে কুহক আছে
সেই বর্ণময় নিরুচ্চার ডাকে, তিনি

জানেন নি আগে।
বেশভূষা জীর্ণ আভিজাত্যের সুদূর ঘ্রাণে ভরপুর, চোখে
দেয়ালে দেয়ালে খোজে চিত্রমালা পূর্বপুরুষের। কখন যে
চোখের দিগন্তে মেঘ জমে ম্লান রক্তজবার মতন, প্রাণে
সুরেলা ধ্বনির প্রেত নেচে ওঠে, দর্পণে দর্পণে
প্রতিবিম্ব নানা দোলাচলে ভাসমান অপসৃত।
কখনো-বা ফ্রয়েডীয় লোকে

নিজের অস্তিত্ব কী উদ্ভভট
ঘেরাটোপে ছায়াচ্ছন্ন দেখে চমকে ওঠেন খুব, বারবার
পালা ক’রে দ্বৈত সত্তা যায় হেঁকে কর্কশ প্রান্তরে,
কখনো নদীর বাঁকে কখনো অরণ্যে, কখনো বা
বালিয়াড়ি ঘেঁষে, চোরাবালিতে কখনো।

রুমালে চাপেন নাক যখন তখন। পচা গন্ধে
টেঁকা দায় ভেবে নক্‌শাময় আলমারি খুলে তিনি
আতরের উজাড় শিশিটা নেড়ে চেড়ে হয়ে যান
দীর্ঘশ্বাস, দুর্গন্ধের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন ক্রমশ,
অথচ নাছোড় গন্ধ করছে বিব্রত তাঁকে রাত্রিদিন।
বুঝি এই স্বস্তি তাড়ানিয়া

গন্ধ তাঁর অস্তিত্বেরই। তবে কি নিজেরই শব ব’য়ে
বেড়াচ্ছেন ভাবলেশহীন? ধ্বংস্তূপ

অথবা পাখির
দগ্ধ বাসা চোখে পড়লেই স্বগৃহের কথা মনে পড়ে তাঁর।

এখনতো চোখ নেই গ্রন্থের পাতায় কিংবা জরুরি দলিলে,
আপাতত নিসর্গের মিতালিতে নিস্পৃহ, কী এক
নিষ্করুণ শোভাযাত্রা দৃষ্টির সম্মুখে। দেখছেন অতিদ্রুত
গজাচ্ছে বিষাক্ত প্রাণীভুক গাছ বসতবাটির
চতুর্ধারে, আর পরগাছা ক্রমশ উঠছে বেড়ে
নিজেরই শরীরে তাঁর, কংকালের বুকে কাক জুড়েছে পাঁচালি।
বারান্দায় পায়রার ঝাঁক
বাজপাখি হয়ে তেড়ে আসে, নিরীহ পুতুলগুলো
হয়ে যায় ঘাতকের মতো অবিকল, দেখছেন
তিনি; শয্যাতল থেকে কতিপয় মৃত নীল হাত
শূন্য পেয়ালার দিকে কেবলি পৌঁছুতে চায়, পদহারা
জুতোগুলো নৃত্যপর চতুর্দিকে, কড়িকাঠে অসংখ্য যুবতী
দমবন্ধু ক্রূর অবেলায়

উদ্বন্ধনে ভয়ানক নিষ্প্রভ এবং আশেপাশে
পুরোনো সিঁড়ির ধাপে বারান্দায় ছাদে দন্তহীন
বৃদ্ধেরা ক্রন্দনরত, উন্মত্ত শিকারী কুকুরের
পাল ক্রমাগত
খুঁড়ছে ঘরের মেঝে, তিনি দেখছেন। চোখে তাঁর
উৎসবমুখর নৌবহর ডুবে যাচ্ছে এবং বুকের মধ্যে
ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, জঠরে ক্রোধান্ধ বাঘ, রুক্ষ
মরুভূমি প্রসারিত ঘরে।

আতংক বিলাস নয় তাঁর, বাস্তবিক
ভীতির পেরেকে কন্টকিত সত্তা, কবন্ধের দল
স্মৃতির ওপরে কুচকাওয়াজ করছে অবিরাম।
তিনি তো দর্পণ স্বকালের।

শোনেন অবাক হয়ে কতো
নতুন শব্দের ঝাঁক, নব্য গায়েনের নীলাম্বর-ছোঁয়া স্বর
কেমন অস্বস্তিকর অথচ বাঁচার মীড়ে মীড়ে
ঝংকৃত পথের ধারে। কেউউ ‘সূর্যাদয় চাই’ বলে
চৌরাস্তায় আকর্ষণ করে ভিড় আর
বিষাদের প্রতিমূর্তি তিনি

জনশূন্যতায় বন্ধ আপন প্রকোষ্ঠে
নিজেকে মেশান শুধু দূরগামী মেঘে, তিনি সূর্যাস্তেরই লোক।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 94

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts