Poem

একদা এক কবিতা

শামসুর রাহমান

একদা এক কবিতা, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতে
পাখাঅলা ঘোড়ার লাগাম,
বেরিয়েছিল একটি ডালিমের খোঁজে,
যা সারিয়ে তুলবে অসুস্থ রাজাকে। একদা এক কবিতা
মায়াবিনীদের স্মৃতি-ভোলানো গান উপেক্ষা করে
ভুরু থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল মতিচ্ছন্নতার ছায়া।

প্রান্তরের পর প্রান্তর পেরিয়ে, ডিঙিয়ে
পাহাড়ের পর পাহাড়
সন্ধ্যেবেলা সে পাখাঅলা ঘোড়াটাকে থামায়
গাছতলায়, জিন থেকে নেমে ডালে ঘোড়ার
লাগাম বেঁধে সে ঘুমায়। ছায়া গ’লে গ’লে
পড়ে ওর চোখে-মুখে স্তব্ধতার সর-পড়া ঠোঁটে, ঘোড়ার লেজে
কুণ্ডলি পাকিয়ে-থাকা জগমোতির হারে। তার পাশ দিয়ে
বয়ে যায় ঝরণা, ঝরণাধারায় ভাসে অসংখ্য গোলাপ।

যখন ওর ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলা
দূর উদ্যানের স্মৃতি বয়ে-আনা পাখির গানে,
সে তার ব্যর্থ অভিযানের কাহিনীগুলো আবৃত্তি করে
মনে-মনে, তারপর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে, কখনো
ঝরণার নুড়ির ওপর দিয়ে দুলকি চালে
যাত্রা শুরু করে, কখনো টগবগিয়ে চলে সবুজ উপত্যকায়,
কখনোবা রঙিন মেঘের পেলবতায়
ঢেউ তোলে পাখাঅলা ঘোড়ার ক্ষুর। কখনো
ওর চোখে এসে লাগে সুদূর ডুমুর পাতার
ঝলক, নাকে দরিদ্রের খড়-ছাওয়া ঘরের বলক-আসা ভাতের ঘ্রাণ।
সেই কবিতা, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতের মুঠোয়
রাশি রাশি নক্ষত্র, লক্ষ্য করে
দূরের মেঘে কিসের কুণ্ডলি, ঘোড়াটা ভড়কে যায়
বেধড়ক, পালাতে চায় উল্টো দিকে।

সে লাগাম টেনে ধরে জোরে, কলকারখানার ধোঁয়া
ওর চারদিকে, চোখে কাঁদানো গ্যাসের দুঃসহ জ্বালা।
কারা যেন তাকে পরিয়ে দেয় কোমরবন্ধ,
আর সেখানে সে দেখতে পায়
খাপে-ঢাকা তরবারি। যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ,
হাতের মুঠোয় রাশি রাশি নক্ষত্র, সে কিছুতেই ভেবে পায় না
এই অস্ত্র তার কী কাজেই বা লাগবে?
পাখাঅলা ঘোড়াটা ঘুরতে থাকে দিগ্ধিদিক।

ঘন অরণ্যের দিকে এগোতে এগোতে সে ডান দিকে
ফেলে দেয় কোষবদ্ধ অসি আর বাঁ দিকে
শপথের মতো দৃঢ় কোমরবন্ধ। আবার ছুটে চলে রোগহর
ডালিমের উদ্দেশে, যার প্রতীক্ষায় আছে রাজ্যের সবাই।

দিন যায়, রাত কাটে, এভাবে চলতে চলতে
একদিন সে অভীষ্ট উদ্যানের
প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, ওর কানে ভেসে আসে
অমর্ত্য গান, সে-গান কোনো পাখির
না নারীর, শনাক্ত করা মুশকিল। অথচ সেখানেই
দশদিক থেকে টর্নেডোর মতো তেড়ে আসে হা রে রে রে
দস্যুদল বল্লম আর অসি উঁচিয়ে
ওর দিকে, যার কাঁধে পূর্ণিমার চাঁদ, হাতে পাখাঅলা ঘোড়ার লাগাম।

এই আচমকা আগ্রাসনে দিশেহারা সে
কোমরে হাত রাখে, কিন্তু সে মুহূর্তে ওর মনে ছিল না
সেখানে না আছে কোমরবন্ধ, না কোনো
তীক্ষ্ণ তরবারি। তার কাঁধের পূর্ণিমার চাঁদ আর
হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে ছুটে আসে ঝাঁক ঝাঁক তীর,
বল্লম, আর ওর অস্তিত্বের
ক্ষতগুলো থেকে ঝরতে থাকে অবিরত
বর্বরদের চম্‌কে দেয়া গোলাপ, সাদা, লাল, হলদে, সবুজ।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 102

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts