Poem

কতকাল আর ঠ্যাকা দিয়ে রাখা যায় ভীষণ পতনশীল
ঘরবাড়ি? এদিকটা সামলাও যদি,
সামলাতে পারো যদি,
সামলাতে পারো কায়ক্লেশে, অথচ ওদিক দ্রুত
হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। ক্ষয়গ্রস্ত
অতীতের ভিত, একালের পলাস্তারা ঝরা পাতা,
ভবিষ্যের খিলান অস্পষ্ট অতিশয়। বাসিন্দারা অনেকেই
উদাসীন; কেন তুমি নিরর্থক এই ভগ্নস্তূপে
বসে আছো গানহীন পাখির মতোন
কোন্‌ সে আশায়? দূরে কুয়াশায় কারা হেঁটে যায়?
ওরা কি শবানুগামী? কনকনে শীতে
জমে গেছে মাতমের ধ্বনি। কেউ কি পারে না ফের উৎসবের বোল তুলে
এ কাল সন্ধ্যায় জ্বেলে দিতে আলো?

কী করে বাঁচবে কেউ এভাবে এখানে,
যেখানে মেধার দ্যুতি নেই, গুমরানি আছে, গান নেই; দশদিকে
মূর্খের প্রলাপ শুধু, অবলুপ্ত জ্ঞানের প্রলেপ?
যে শতকে ঘরে ঘরে রিরংসার নৃত্য অবিরাম, ভালোবাসা
দরজার বাইরে দাঁড়ানো, আস্তে হাত থেকে খসে যায়
স্নিগ্ধতার উৎফুল্ল মুকুল,
চোর ডাকাতের সঙ্গে এক দড়িতেই ফাঁসি দেয় মহত্বকে
অত্যন্ত কর্কশ দস্যু এবং সত্যের গলা বার বার চেপে
ধরে কদাকার হাতে মিথ্যাচার, সে নিষ্ঠুর, বড় ভয়াবহ
শতকেও অসহায়, সন্ত্রস্ত মানুষ পথ হাঁটে,
খায় দায়, ভালোবাসা পেতে চায়, লুকিয়ে চুরিয়ে ধুলোমাখা
সেতার কী ব্যগ্র খোঁজে, বাঁচবার তীব্র সাধ বুকে লগ্ন তার।
কেউ কেউ ভগ্নকণ্ঠে বলে, ‘সে আসুক’। কে সে যার
প্রতীক্ষায় টেরাকাটা মূর্তির ধরনে সকলেই
স্তব্ধ হয়ে আছে দিগন্তের দিকে চেয়ে এমন উৎসুক? কারো
অন্য কোনো উৎসাহ, উদ্যম নেই যেন
বিরতিহীন এই প্রতীক্ষা ব্যতীত। তুমি, হ্যাঁ তুমিও গালে
হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেকিয়ে পিঠ নিশ্চুপ, নিঃসাড়
হয়ে আছো, প্রায় বজ্রাহত। এদিকে তো পুনরায়
প্রাগৈতিহাসিক জন্তু, অতিকায়, ভয়ঙ্কর, মুখের গহ্বরে
তার নিচ্ছে পুরে একে একে
সৃজনের যাবতীয় উপাদান অকাতরে। তবু প্রেতজব্দ মানুষেরা
ভাবলেশহীন; ফিসফিসে কণ্ঠে বলে-
‘একটু অপেক্ষা করো, জ্বালো না প্রদীপ, সে আসুক’।

কে সে? কে সে? অলৌকিক কেউ? আসবে ময়ূরপঙ্খী
ভাসিয়ে গহীন গাঙে? সে কি
হাওয়াই জাহাজ থেকে প্যারাসুটহীন
নামবে জমিনে নীলিমার উল্কি নিয়ে রঙিলা সত্তায় তার? এ সওয়াল
কখনো উতলা করে কাউকে কাউকে,
অথচ জবাব নেই এখনো কোথাও। আছে শুধু স্থবিরতা,
জরাক্লিষ্ট রাজা যেন। হাতে দেশলাই
নিলে কেউ সকলেই বলে সমস্বরে, ‘শোনো, আরো
কিছুকাল দেখা যাক, সে আসুক’। বুঝি ওরা অন্ধকার
চাদরের মতো ব্যবহার করে যেতে ভালোবাসে।
না কি আজ হঠাৎ এদের কেউ প্রতীক্ষার গালে
চড় মেরে ফস্‌ করে জ্বেলে দেবে দীপ? নাচবে নক্ষত্রমালা।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 95

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts