Poem

কেমন বেঘোরে নিমজ্জিত

শামসুর রাহমান

প্রকাশপ্রবণ ষড়ঋতুতে এবং ঘোরলাগা
আত্মাদর্শী; ‘হায় নিস্তব্ধতা, হায় নিস্তব্ধতা’ ধ্বনি
দিয়ে চক্রবাল ছুঁই। দূরবর্তী গোচারণ ভূমি, নদীতীরে,
ত্রস্ত পক্ষীযূথ, পথরেখা ক্রমশ ভৌতিক; যদি
এক হাঁড়ি নিথর দধির মতো চাঁদ হাতে এসে
ডাগর আহ্‌লাদ হতো, করজোড়ে দাঁড়াতাম আকাশের নিচে।

বস্তুত আমার কোনো পূর্বজন্ম নেই, তুব কেন
স্মৃতি এরকম জাতিস্বর? তেজী জ্যোৎস্নাবিচলিত
দীঘির প্রাচীনতায় পূর্বপুরুষের ছায়াবৎ প্রতিকৃতি
দেখে গরীয়ান; খুঁজি কার পাণ্ডুর অধরে শ্লোক
বিচ্ছুরিত, কার হাতে অচিন প্রকাশক্ষম এক
খাগের কলম শোভা? হায়, দীঘির রহস্য গূঢ় ঘনীভূত।

বিসদৃশ ধারাবাহিকতা মরীচিকা; হয়তো বা
জরাবৃত, অন্ধকার বাসগৃহে আগরবাতির
মোহাচ্ছন্ন ধোঁয়া, বিসর্পিল। বুঝি কারো পলকরহিত নগ্ন
চাহনিতে শিখা, তারার স্পন্দন, না-বুঝেই তাকে
অলোকসামান্য আপনার জন ভাবি আলিঙ্গনে।

চমকিত অতীতের ধূসরিত তবু মনোহারিত্ব অসীম
আপাতশোভন ডালা খুলে দ্যাখে এ বদনসীব-
জমেনি সঞ্চয় কিছু; নির্বোধের মুখ ব্যাদানের
মতো শূন্যতার উপহাসে কী-যে কম্পমান ক্ষয়িত শরীর।
হৃদয়ের তন্তুজালে মুণ্ডুহীদের তড়পানি;
‘সাড়া দও মেধা, শিল্প’ ব’লে নিঃশব্দ চেঁচাই;
গলার ভেতরে ধুলো, ছাই ওড়ে, রুদ্ধ ফিনিক্সের জাগরণ।

ঘাসঢাকা সিঁড়িতে নিবিষ্ট বসে ডায়েরিতে ঝুঁকে
পড়ন্ত বেলায় কিছু পংক্তি রচনার ধ্যানে থাকি,
শরীর হাওয়ার চাপে হৈমন্তিক স্বপ্নের ধনুক, ছিলা শত
টুকরো, তালু ফুঁড়ে বিষপায়ী কাঁটাতার, অকস্মাৎ
ছন্নছাড়া ঝড়, কালীদহে তোলপাড়, অবসাদ।
খসে যায়, অস্থির আঙুল থেকে কলম কেবলি খসে যায়।

এই আমি বানিয়েছি এসব অক্ষর? তবে কেন
এমন অচেনা লাগে? পংক্তির ভেতরে অন্য পংক্তি
সোহাগকাঙাল মদ্যপের মতো ঢুকে পড়ে। আমার স্বাক্ষরে
অন্য কারো স্বাক্ষরের অদ্ভুত আদল; দৌড়ে যাই,
জংলী লতাগুল্মে পা আটকে পড়ে থাকি, ন্যাবাধরা;
কেমন বেঘোরে নিমজ্জিত অবচেতনের মেঘময়তায়।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 100

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts