Poem

চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়

আল মাহমুদ

আমার চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়, তখুনি আমার ভয়।
মনে হয় চোখ যেন আস্তে আস্তে কানের দিকে সরে যাচ্ছে।
কিম্বা শ্রবণেন্দ্রীয় এসে আমার চোখের ভেতর
শব্দের রাজদণ্ড ধরেছে।
যেদিকে তাকাই, শুধু শুনতে পাই। শুনতে পাই
দূরাগত ভাঙনের শব্দ। যেন বিশাল চাঙড়
ভেঙে পড়ছে কোথাও। আর ছিঁটকে পড়া জলের কণায়
আমি আর চোখ মেলতে পারি না।

আমি যখন ছোটো, আমাদের গ্রাম ছিল
এক উদ্দাম নদীর আক্রোশের কাছে। ক্রমাগত ভাঙনের রেখা
ধীরগতিতে গ্রামকে উজাড় করে এগোতে থাকলে
আমি প্রাত্যহিক ভাঙনের খবর আমার মাকে এনে দিতাম।
দৌড়ে এসে বলতাম, আজ ইদ্রিসদের
গোয়াল ঘরটা গেল মা।

আমার বাপের ছিল অঘুমের অসুখ। সারারাত
ধস নামার শব্দ পোহাতেন। কখনো দেখতাম
সড়কি নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছেন।
আমি তার পেছন নিলে বলতেন, আয়
কোথায় চর জাগলো দেখে আসি।
দশ মাইলের মধ্যে চরের খবর মাঝিরা কেউ জানতো না।
গলুইয়ের ওপর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে
তারা দুর গঞ্জের দিকে চলে গেলে
আমরা ঘরে ফিরতাম!

ভাঙন যখন চল্লিশ গজের মধ্যে এগোলো। আমার বাপ
তখন অসুস্থ। কি তার অসুখ ছিল জানি না,
কেবল আমাকে নদীর কাছে যেতে বলতেন। বলতেন
জেনে আয় কোন্ দিকে চর পড়েছে।
আমি তার কথায় দৌড় দিতাম। কিন্তু ফিরে এসে বলতাম
আজ কৈবর্তপাড়ার নলিনীদের ভিটেবাড়ি ভাঙলো বাবা।
মা চোখ টিপতেন। কিন্তু আমি তো ছিলাম শিশু
যে মিথ্যা বলতে শেখেনি। একদিন এ-ভাবেই
সব শেষ হয়ে গেল।

যেদিন নদী এসে আমাদের বাড়িটাকে ধরলো
সেদিনের কথা আমার চোখের ওপর স্থির হয়ে আছে।
বাক্সপেটরা থালা ঘটিবাটি নিয়ে আমরা
গাঁয়ের পেছনে বাপের কবরে গিয়ে দাঁড়ালাম।
জায়গাটা ছিল উঁচু আর নিরাপদ। দেখতে
অনেকটা চরের মতোই। মা সেখানে বসে
হাঁপাতে লাগলেন। কাদলেন এমনভাবে যে
অভিযোগহীন এমন রোদন ধ্বনি বহুকাল শুনিনি আমি।
তারপর ভাঙনের রেখা পেছনে রেখে
আমরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছিড়ে পড়লাম।
কেউ গেলাম মামুর বাড়িতে। কেউ ফুপুর। যেমন
বাবেল থেকে মানুষের ধারা
ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীতে।

Author Bio

মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) যিনি আল মাহমুদ নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক,

More

This post views is 223

Post Topics

Total Posts

80 Published Posts