Poem

চল নামি-আষাঢ় আসিয়াছে-চল নামি।

আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টিবিন্দু, একা এক জনে যূথিকাকলির শুষ্ক মুখও ধুইতে পারি না-মল্লিকার ক্ষুদ্র হৃদয় ভরিতে পারি না। কিন্তু আমরা সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি,-মনে করিলে পৃথিবী ভাসাই। ক্ষুদ্র কে?

দেখ, যে একা, সেই ক্ষুদ্র, সেই সামান্য। যাহার ঐক্য নাই, সেই তুচ্ছ। দেখ, ভাই সকল কেহ একা নামিও না-অর্দ্ধপথে ঐ প্রচণ্ড রবির কিরণে শুকাইয়া যাইবে,-চল, সহস্রে সহস্রে, লক্ষে লক্ষে, অর্ব্বুদে, অর্ব্বুদে এই বিশোষিতা পৃথিবী ভাসাইব।

পৃথিবী ভাসাইব। পর্ব্বতের মাথায় চড়িয়া, তাহার গলা ধরিয়া, বুকে পা দিয়া, পৃথিবীতে নামিব ; নির্ঝরপথে স্ফটিক হইয়া বাহির হইব। নদীকূলের শূন্যহৃদয় ভরাইয়া, তাহাদিগকে রূপের বসন পরাইয়া, মহাকল্লোলে ভীম বাদ্য বাজাইয়া, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ মারিয়া, মহারঙ্গে ক্রীড়া করিব। এসো, সবে নামি।

কে যুদ্ধ দিবে-বায়ু। ইস! বায়ুর ঘাড়ে চড়িয়া দেশ দেশান্তরে বেড়াইব। আমাদের এ বর্ষাযুদ্ধে বায়ু ঘোড়া মাত্র ; তাহার সাহায্য পাইলে স্থলে জলে এক করি। তাহার সাহায্য পাইলে, বড় বড় গ্রাম অট্টালিকা, পোত মুখে করিয়া ধুইয়া লইয়া যাই। তাহার ঘাড়ে চড়িয়া, জানালা লোকের ঘরে ঢুকি। যুবতীর যত্ননির্ম্মিত শয্যা ভিজাইয়া দিই-সুষুপ্ত সুন্দরীর গায়ের উপর গা ঢালি। বায়ু! বায়ু ত আমাদের গোলাম।

দেখ ভাই, কেহ একা নামিও না-ঐক্যেই বল-নহিলে আমরা কেহ নাই। চল-আমরা ক্ষুদ্র বৃষ্টিবিন্দু-কিন্তু পৃথিবী রাখিব। শস্যক্ষেত্রে শস্য জন্মাইব-মনুষ্য বাঁচিবে। নদীতে নৌকা চালাইব-মনুষ্যের বাণিজ্য বাঁচিবে। তৃণ লতা বৃক্ষাদির পুষ্টি করিব-পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বাঁচিবে। আমরা ক্ষুদ্র বৃষ্টিবিন্দু-আমাদের সমান কে? আমরাই সংসার রাখি।

তবে আয়, ডেকে ডেকে, হেঁকে হেঁকে, নবনীল কাদম্বিনী! বৃষ্টিকুলপ্রসূতি! আয় মা দিঙ্মণ্ডলব্যাপিনী ; সৌরতেজঃসংহারিণি! এসো এসো গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন কর, আমরা নামি! এসো ভগিনি সুচারুহাসিনি চঞ্চলে! বৃষ্টিকুলমুখ আলো কর! আমরা ডেকে ডেকে, হেসে হেসে, নেচে নেচে, ভূতলে নামি। তুমি বৃত্রমর্ম্মভেদী বজ্র, তুমিও ডাক না –এ উৎসবে তোমার মতো বাজান কে‌ ? ‌তুমিও ভূতেল পড়িবে? পড়, কিন্তু কেবল গর্ব্বোন্নতের মস্তকের উপর পড়িও। এই ক্ষুদ্র পরোপকারী শস্যমধ্যে পড়িও না-আমরা তাহাদের বাঁচাইতে যাইতেছি। ভাঙ্গ ত এই পর্ব্বতশৃঙ্গ ভাঙ্গ ; পোড়াও ত ঐ উচ্চ দেবালয়চূড়া পোড়াও। ক্ষুদ্রকে কিছু বলিও না-আমরা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্রের জন্য আমাদের বড় ব্যথা।

দেখ, দেখ, আমাদের দেখিয়া আহ্লাদ দেখ! গাছপালা মাথা নাড়িতেছে-নদী দুলিতেছে, ধান্যক্ষেত্র মাথা নামাইয়া প্রণাম করিতেছে-চাষা চষিতেছে-ছেলে ভিজিতেছে-কেবল বেনে বউ আমসী ও আমসত্ত্ব লইয়া পলাইতেছে। মর্ পাপিষ্ঠা! দুই একখানা রেখে যা না-আমরা খাব। দে, মাগীর কাপড় ভিজিয়ে দে।

আমরা জাতিতে জল, কিন্তু রঙ্গরস জানি। লোকের চাল ফুটা করিয়া ঘরে উঁকি মারি-দম্পতির গৃহে ছাদ ফুটা করিয়া টু দিই। যে পথে সুন্দর বৌ জলের কলসী লইয়া যাইবে, সেই পথে পিছল করিয়া রাখি। মল্লিকার মধু লইয়া গিয়া, ভ্রমরের অন্ন মারি। মুড়ি মুড়কির দোকান দেখিলে প্রায় ফলার মাখিয়া দিয়া যাই। রামী চাকরাণী কাপড় শুকুতে দিলে, প্রায় তাহার কাজ বাড়াইয়া রাখি। ভণ্ড বামুনের জন্য আচমনীয় যাইতেছে দেখিলে, তাহার জাতি মারি। আমরা কি কম পাত্র! তোমরা সবাই বল-আমরা রসিক।

তা যাক্-আমাদের বল দেখ। দেখ, পর্ব্বতকন্দর, দেশ প্রদেশ ধুইয়া লইয়া, নূতন দেশ নির্ম্মান বিশীর্ণা সূত্রাকারা তটিনিকে কূলপ্লাবিনী দেশমজ্জিনী অনন্তদেহধারিণী অনন্ত তরঙ্গিণী জলরাক্ষসী করিব। কোন দেশের মানুষ রাখিব-কোন দেশের মানুষ মারিব-কত জাহাজ বহিব, কত জাহাজ ডুবাইব-পৃথিবী জলময় করিব-অথচ আমরা কি ক্ষুদ্র! আমাদের মত ক্ষুদ্র কে? আমাদের মত বলবান্ কে?

Author Bio

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাকে সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক

More

This post views is 411

Post Topics

Total Posts

16 Published Posts