Poem

বসন্ত নয় অবহেলা

দর্পণ কবীর

বসন্ত নয়, আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিলো অবহেলা
ভেবেছিলাম, অনেকগুলো বর্ষা শেষে শরতের উষ্ণতা মিশে এলো বুঝি বসন্ত!
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালোবেসে এসেছে অবহেলা

মধ্য দুপুরের তির্যক রোদের মতো
অনেকটা নির্লজ্জভাবে আমাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম
আমার দীনদশায় কারো করুণা বা আর্তিব পেখম ছড়িয়ে আছে কি না
ছিলো না

বৃষ্টিহীন জনপদে খড়খড়ে রোদ যেমন দস্যুর মতো অদমনীয়
তেমনি অবহেলাও আমাকে আগলে রেখেছিলো নির্মোহ নিঃসংকোচিত
আমি অবহেলাকে পেছনে ফেলে একবার ভোঁ-দৌড় দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম

তখন দেখি আমার সামনে কলহাস্যে দাঁড়িয়েছে উপেক্ষা

উপেক্ষার সঙ্গেও একবার কানামাছি খেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের কোলাহল মুখর আনন্দ সভায়
কি মিলেছিলো?
ঠোঁট উল্টানো ভৎসনা আর অভিশপ্ত অনূঢ়ার মতো এক তাল অবজ্ঞা
তাও সয়ে গিয়েছিলো একটা সময়
ধরেই নিয়েছিলাম আমার কোনো কালেই হবে না রাবেন্দ্রিক প্রেম
তোমাদের জয়গানে করতালিতে নতজানু থেকেছিলো আমার চাপা আক্ষেপ লজ্জা
বুঝে গিয়েছিলাম জীবনানন্দময় স্বপ্ন আমাকে ছোঁবে না

জয়নুলের রঙ নিয়ে কল্পনার বেসাতি
হারানো দিনের গানের ঐন্দ্রালিক তন্ময়তা
বা ফুল, পাখি, নদীর কাব্যালাপে কারা মশগুল হলো, এ নিয়ে কৌতূহল দেখাবার দুঃসাহস আমি দেখাইনি কখনো

এত কিছু নেই জেনেও নজরুলের মতো বিদ্রোহী হবো, সেই অমিত শক্তিও আমার ছিলো না
মেনে নেয়ার বিনয়টুকু ছাড়া আসলে আমার কিছুই ছিলো না
শুধু ছিলো অবহেলা, উপেক্ষা আর অবজ্ঞা

হ্যাঁ, একবার তুমি বা তোমরা যেন দয়া করে বাঁকা চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে
তাচ্ছিল্য নয়, একটু মায়াই যেন ছিলো
হতে পারে কাঁপা আবেগও মিশ্রিত ছিলো তোমার দৃষ্টিতে

ওইটুকুই আমার যা পাওয়া

আমি ঝড়ে যাওয়া পাতা, তুমি ছিলে আকস্মিক দমকা হাওয়া
তারপরও অবহেলার চাদর ছাড়িয়ে
উপেক্ষার দেয়াল ডিঙিয়ে
ও অবজ্ঞার লাল দাগ মুছে জীবনের কোনো সীমারেখা ভাঙতে পারিনি আমি

এ কথা জানে শুধু অন্তর্যামী

অনেক স্বপ্নপ্রবণ হয়ে একবার ভেবেছিলাম
এই অবহেলা তুষারপাতের মুখচ্ছবি, উপেক্ষা কাচের দেওয়াল, অবজ্ঞা কুচকুচে অন্ধকার

এর কিছুই থাকবে না একটি বসন্তের ফুঁৎকারে
একটি ঝলমলে পোশাক গায়ে চড়িয়ে হাতের মুঠোয় বসন্ত নিয়ে অন্তত একটি সন্ধ্যাকে উজ্জ্বল করে নেবো

এমন ভাবাবেগও ছিলো আকাশের কার্নিশে লেপ্টে থাকা পেঁজা মেঘের মতো
ঐ মেঘ কখনো বৃষ্টি হয়ে নামেনি
তোমার বা তোমাদের নাগরিক কোলাহল কখনো থামেনি
অর্ধেক জীবন ফেলে এসে দেখি অনেক কিছু বদলে গেছে
সেকি!

কোথায় হারালো কৈশোরের দিনলিপি বিপন্ন করা অবহেলা
স্বপ্নকে অবদমনের স্বরলিপিতে আটকে ফেলা উপেক্ষা
আর তারুণ্যকে ম্রিয়মাণ করে রাখার অবজ্ঞা
ওরা আমাকে চোখ রাঙাতে পারে না ঠিক, তবে এখনো পোড় খাওয়া দিন বড্ড রঙিন

আমি আজ সমুদ্র জলে হাত রেখে বলে দিতে পারি
কোন ঢেউয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তোমাদের গোপন অশ্রুকণা

আকাশ পানে তাকিয়ে বুঝতে পারি কার দীর্ঘশ্বাসে ঝড়ে পড়ছে নক্ষত্র
এমনকি তুমি যে সম্রাজ্ঞীর বেশের আড়ালের মিহিন কষ্ট চেপে হয়েছো লাবণ্যময় পাষাণ, পাথর
এটাও দেখতে পাই অন্তরদৃষ্টি দিয়ে

আমি জানি, দীর্ঘশ্বাসে ভরা এ আখ্যান যদি পেতো কবিতার রূপ
সেই অবহেলা হতো বসন্ত স্বরুপ

Published Comments

  1. আপনার এই কবিতার ঘোর ৩ বছরে মুহূর্তের জন্য মন থেকে মুছতে পারিনি । সত্যিই অসাধারণ। বাংলা কবিতায় রেনেসাঁ মনে হচ্ছে।

Author Bio

দর্পণ কবীরের জন্ম নারায়ণগঞ্জ শহরে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সম্পন্ন করার পরপরই ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত হন। শিশু বয়স থেকে ছড়া-কবিতা লেখার চর্চা শুরু। একসময় সাংবাদিকতার পাশাপাশি তার লেখক পরিচয়টাও

More

This post views is 3950

Post Topics

Total Posts

72 Published Posts