Poem

যদি আর বাঁশি না বাজে

কাজী নজরুল ইসলাম

বন্ধুগণ,

আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রান আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই, শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলী কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাঁকে ক্ষুধা দীর্ণ মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।

আমাকে বিদ্রোহী বলে, খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আছড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছে আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা কুলুষিত পুরাতন পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কেউ বলেন, আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের, আমি বলি ও দুটোর কেনটাই নই, আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলান যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগপেতে হবেনা। কেননা এক জনের হাতে আছে লাঠি আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিন-রাত হানা-হানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋন-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা খ্যাতি চাইনা প্রতিষ্ঠা চাইনা নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলীর মত, কিটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত – হ, জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত, মেঘের উর্দ্ধে শুন্যের মতো কেবল হাসি কেবল গান কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা- আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়েছে, ঠিক সেই দিনই সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য থেকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ন্যত্বের তৃষা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্না যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।

যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি- আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে, এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।

যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগী-বীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা, এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু, তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি-

“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা,

কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা,

নিশ্চল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী,

গন্ধ বিধুর ধূপ”।

Author Bio

কাজী নজরুল ইসলাম, রাঢ় বাংলায় জন্ম নেওয়া একজন বাঙালি কবি এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি

More

This post views is 585

Post Topics

Total Posts

365 Published Posts