Poem

ধ্রুপদি দ্রৌপদী বর্ষা

নির্মলেন্দু গুণ

বাংলার ষড়্ঋতুর ভেতরে বর্ষাই হচ্ছেন একমাত্র নারী। বাকি সবাই হলেন পুরুষ ঋতু। গ্রীষ্ম (গ্রীষ্মদেব ঠাকুর, এ নামটি না থাকলেও, নাম হিসেবে গৃহীত হতে পারে); শরৎ (লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়); হেমন্ত (গায়ক হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়); শীত (কবি শীতলদাস জোয়ারদার); বসন্ত (নায়ক বসন্ত চৌধুরী)—এঁরা সবাই পুরুষ। বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছেন মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব।
বর্ষার ওপর একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যরচনা লিখতে বসে, কী লিখি, কী লিখি, ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করেই বর্ষার এ বিশেষ রমণীয় রূপটি আমার নজরে পড়ল। আমার আগে কেউ কি বর্ষা ঋতু নিয়ে এ রকম করে ভেবেছেন? মনে হয় না। যে কামানুভূতির নিগূঢ় মিথস্ক্রিয়ার ভেতরে প্রকৃতি-জগতের এ গূঢ় সত্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই সাধনপথের পথিক বাংলা সাহিত্যে খুব একটা সুলভ নয়। দৃষ্টি যদি অন্ধ থাকে রজস্বলা প্রকৃতির দিকে, লাভ নেই তার সাধনে-আহ্নিকে।
এই পর্যন্ত লেখার পর বুঝতে পারছি, বর্ষার ওপর পদ্য রচনা করাটা বরং সহজ, গদ্য রচনা করা কঠিন। বর্ষা বাঙালির মনের ভেতরে নিয়ে আসে ভাবজগতের বাণী। তাই লক্ষ করছি, আমার রচনাটি বস্তুজগৎ ছেড়ে ক্রমশ ভাবজগতের দিকে তার ডানা মেলতে শুরু করেছে। আমার বিশ্বাস, অধিকাংশ বাঙালি কবির কাব্যজীবনই শুরু হয় বর্ষার ওপর কবিতা রচনা করার মধ্য দিয়ে। বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার জন্য আমি বাংলা কবিতার গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কবিতার অর্ঘ্য দিয়ে বর্ষাকে তুষ্ট না করে কোনো বাঙালি কবির কবিজন্ম শুদ্ধ হবার নয়। সম্ভবত হয়ওনি। আর আমি? আমি তো এই রমণীরই গর্ভজাত। আমার জন্ম সাতই আষাঢ়। আমি বর্ষার জাতক। আর জাতক হলে যা হয়, বর্ষাকে নিয়ে আমি আর কী ভাবব, দুরন্ত সন্তানের জননীর মতো তিনিই আমাকে নিয়ে সর্বদা ভাবেন। আমাকে তিনি আপন হাতে আগলে রাখেন সকল বিপদ ও বিপর্যয় থেকে। তিনি নিজের হাতে আমার জীবনকে সাজিয়ে দেন, ফুলে ফলে ভরিয়ে দেন এবং আমার জীবনের স্বপ্নকে পূর্ণ করে দেন। তার প্রমাণও এবার হাতেনাতেই পেলাম এবার আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে।
আমি আমার গ্রামের বাড়িতে একটি পাঠাগার তৈরি করেছি। আমার শিক্ষানুরাগী পিতামহের নামে ওই পাঠাগারের নাম রেখেছি রামসুন্দর পাঠাগার। ওই পাঠাগারের সামনে তৈরি করেছি একটি অনুষ্ঠান-মঞ্চ। আমাদের গ্রামের একজন প্রাচীন গীতিকবির নামে ওই মঞ্চের নাম রেখেছি বীরচরণ মঞ্চ। রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীসহ ওই মঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এলাকার শত শত মানুষ সেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সানন্দে উপভোগ করেন। আমার প্রতিষ্ঠিত স্কুল কাশবন বিদ্যানিকেতনসহ এলাকার অন্যান্য স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও সেসব অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। ওই স্কুল ও পাঠাগার সম্পর্কে কিছু তথ্য ও ছবি প্রথম আলোর (ছুটির দিনে) পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। একটি পুকুরও খনন করেছি পাঠাগারের পাশেই। আঠারোটি লাল সিঁড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পুকুরঘাটটি। বর্ষাগমে সেই পুকুরে ফুটেছে আমাদের জাতীয় ফুল লাল শাপলা। পুকুরঘাটে বসলে চোখ জুড়িয়ে যায়। পুবের হাওয়া (নজরুলের কাব্যগ্রন্থ) ও দখিন হাওয়া (রবীন্দ্রনাথের বসন্ত পর্যায়ের গান) ছুটে এসে পুকুরঘাট আর রামসুন্দর পাঠাগারের বারান্দায় লুটোপুটি খায়। শুধু চোখ নয়, মানুষের শরীরও জুড়ায় সেই শীতল হাওয়ায়।
খনন করার পর গ্রীষ্মকালজুড়ে ওই পুকুরটি ছিল জলশূন্য। একটা বিরাট গহ্বরের মতো। দেখলে ভয় হতো। ভাবি, সাগরের জল শুকিয়ে গেলে যে কী কাণ্ড হবে! ওই ভয়াল গহ্বরটি প্রত্যক্ষ করার শক্তি কি থাকবে মানুষের?
‘বর্ষার অজস্র জলাধার’ ওই পুকুরটি (সুখেন্দু-শুভেন্দু সরোবর) এখন কানায় কানায় পূর্ণ। বর্ষা কী সহজেই তার বক্ষনিঃসৃত জল দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছে ওই সদ্য কাটা পুকুরের ভয়াল শূন্যতাকে! লাল শাপলার পাশাপাশি কিছু পদ্মফুলও লাগানো হয়েছে। কিন্তু সেগুলো এখনো পুকুরের জল ও মাটির সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে বাঁচার জন্য। সেগুলো ফুটলে পুকুরটা পরিণত হবে সত্যিকারের সরোবরে। ওই জলভরা পুকুরে আজকাল আমি স্বপ্নে সাঁতার কাটি নিত্যদিন। বর্ষণমুখরিত এক রাতে আমি এর ঘাটে বসে শুনেছি পুকুরমঞ্চে বৃষ্টির গান।
রাতের বেলায় যখন ওই পুকুরের জলে বিদ্যুৎশোভিত রামসুন্দর পাঠাগারের ছায়া পড়ে, পাশের সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় পথিকেরা সেই দৃশ্য প্রাণ ভরে উপভোগ করেন।
একবার বলেছি, বর্ষাই আমার দেখভাল করে। বর্ষাই আমার স্বপ্ন পূরণ করে। তাই যদি না হবে, তবে রামসুন্দর পাঠাগারের পেছনের যে কদমগাছটি তার ডালপালা পাগল করে ফোটা কদম ফুলের সৌরভ বিতরণ করে চলেছে, আমরা কেউ কিন্তু ওই গাছটি সেখানে কখনো রোপণ করিনি। কদমগন্ধে মুগ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আম-জাম-কাঁঠালের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা ওই আচালা বৃক্ষটির অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। এ এক রহস্য বটে।
বর্ষা যে কখন তার এ প্রতীক-বৃক্ষটি আমার জন্মভিটায় রোপণ করেছিলেন, তা তিনিই জানেন। রামসুন্দর পাঠাগারের দক্ষিণ পাশের ফলভারে নত জামগাছটি সম্পর্কেও একই কথা। বর্ষার এ প্রতীক-বৃক্ষটির জন্মকাহিনিও আমাদের সকলের জ্ঞানবহির্ভূত।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০১০

Author Bio

নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী (জন্ম ২১ জুন ১৯৪৫, ৭ আষাঢ় ১৩৫২ বঙ্গাব্দ), যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত, একজন বাংলাদেশী কবি এবং চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন।

More

This post views is 142

Post Topics

Total Posts

107 Published Posts