Poem

শ্বেতাঙ্গের শরে বিদ্ধ

নির্মলেন্দু গুণ

চোখেতে গভীর স্রোত, বিধ্বংসের নায়াগ্রা প্রপাত
বিশ্রামহীন ভেসে যায় রোজ।
ক্লান্ত মাকড় যেন কানে এসে সরল পর্দায়
বাধে বাসা, অন্নহীন, গৃহহীন বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ
প্রতিদিন আমার শিরায়, রক্তে, বন্ধ-দরোজায়
সাংকেতিক টোকা দেয় টক-টক অভিসারী প্রেমিকার মতো।
অতঃপর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে
দরোজা খুলেই দেখি অহর্নিশ সমুখে দাঁড়ায়
আমারই প্রতিবেশী সদর আলী, নরেশ বাড়ই।

কী যেন বললো তারা, কান্না? প্রতিবাদ?
নির্মোক পাখির মতন আমিও তখন
ভুলে যাই সহজে কূজন,
চোখের দু’হাত দূরে খেলা করে সুজন অতীত।
আর মুহূর্তেই একটি বিদেশী যুবক,
সবল-পেশল দেহ, অতি কৃষ্ণকায়,
খাটো চুল, পুরু-ঠোঁট নিয়ে আমাদেরই
অসন্তুষ্ট জনতার সাথে মিশে যায়।
তখন চোখের দ্রুত গভীর প্রপাতে
ভেসে আসে অনন্তের জল,
সুদূর আফ্রিকা থেকে ভেসে-আসা
ছয়টি ফাঁসের বাঁধে আমার বঙ্কিম কণ্ঠ
বেঁধে ফেলে কঠিন বাঁধনে।

তখন চৈতন্যলোকে নিশ্চুপ নিরুত্তর থেকে
চেয়ে দেখি পৃথিবীর বর্তমান দুখের বারুণী,
শিশুর হাতের বাঁশি গর্জে ওঠে নাপামের স্বরে।
আর আমি হয়ে যাই আমেরিকার শহরে-বন্দরে
কার্যরত, ক্লান্ত প্রাণ নিগ্রোদের মতো।

আমার দু’পাশে দুই নিগ্রো বালক
মলিন দু’হাত দেখে বলছে; ‘দেখুন,
আপনার হাতের রেখা অবিকল আমার মতন,
আমি খুব নিদ্রাতুর, আপনার হাতের তালুতে
কিছুক্ষণ নিদ্রা যেতে পারি?’

হাজার হাজার শিশু প্রতিদিন এইভাবে
হাতের তালুতে, বক্ষে, দেহের শিরায় নিদ্রা যেতো,
দেশে দেশে সুশোভিত পৌরুষের কমল ফোটাতো।
‘গৃহস্থের খোকা হোক’-বলে যে সবুজ পাখি
প্রতিদিন ডাকতো হৃদয়ে, শান্তির সেই পাখি
গতরাত শ্বেতাঙ্গের শরে বিদ্ধ হলো।

আর তাই বুঝি আমি, আমার তালুতে, বক্ষে,
দেহের শিরায় ঘুম-যাওয়ার সব শিশু
কেঁদে কেঁদে উড়ে গেল পাখির মতন;
নিহত শান্তির দেশে শ্বেতাঙ্গের শরে বিদ্ধ হতে।

Author Bio

নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী (জন্ম ২১ জুন ১৯৪৫, ৭ আষাঢ় ১৩৫২ বঙ্গাব্দ), যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত, একজন বাংলাদেশী কবি এবং চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন।

More

This post views is 107

Post Topics

Total Posts

107 Published Posts