কী দেখো অমন করে আমার ভিতরে?
আমি দেখি, আমি কি কেবলই দেখি? নীহারিকা,
শুধু পটে লিখা, তুমি কি কেবলই ছবি?
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে-মানুষেরে। আমি তাই
চোখে চোখে ভালোবাসা দেখি, ভাবি,
বাচাল ছেলের মতো বেয়াদপ পঙক্তিগুলো
কী ক’রে যে প্রতিদিন লজ্জাহীন নাচায় আমাকে।
তোমার শয়ন ঘরে সারারাত নাচি ধেই ধেই,
তুমি থাকো, আমি থাকি পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে
কোনোই দেয়াল যেন নেই মাঝখানে।
চোখে চোখ থাকে, হাতের ভিতরে তার মাংসপিণ্ড
জ্বলে, কথা দিয়ে কথাকে জড়াই।
ক্ষীণ কটি আলো দেয় কৃষ্ণ-কররেখার আঁধারে,
তবু রোজ মন এসে বলে : ভালোবাসা বলে কিছু নাই।
মৃত্যু আর রমণীরা যেন ঠিক সমান বয়সী,
অভাব আর অক্ষমতা জীবনের সমান দোসর।
আমি যাকে ভালোবাসি, যাকে ভাবি সবচেয়ে
প্রিয়তম জন, সে আমার জন্মাবধি অভিন্ন মরণ।
কিছুই হয় না বলে লিখছি কবিতা, আত্মতুষ্টি ছাড়া
তাই এর মূল্য কোনোকিছু নাই। উপরন্তু তুমি রুদ্র,
তোমার ওখানে যেতে ভয় পাই, যেহেতু বন্যাকে
রোখে কবিতার যতিচিহ্ন নয়, প্রেমের আগুনে-পোড়া
কোমল মোমের সাদা ছাই। তবুও কবিতা লিখি,
কবিতার অন্তরালে তোমাকে জানাতে চাই এবং
বানাতে চাই একটি শব্দের মানুষ, অবিকল
আমার মতন করে মৃত্যুহীন তোমার ভিতরে।
সবচেয়ে কম দাবি নিয়ে যার সাথে নিত্য সহবাস,
সবচেয়ে কম কথা বলে যাকে খুব কাছে পাওয়া যায়,
সবচেয়ে কম ভালোবেসে যার কাছে অভিমান থাকে,
তাকেও বিরক্ত করি মাঝে মাঝে, মাঝে মাঝে তাকেও জাগাই
ডেকে অসময়ে মধ্যরাতে সাধুসঙ্গ থেকে। মুহূর্তেই
সে-মানুষ রক্তের শাড়ি পরে হয়ে ওঠে আকাঙ্ক্ষিতা নারী,
পায়েতে ঘুঙুর বাঁধা, খোঁপায় অজস্র পাখি
বাঁকানো বাহুর বৃত্তে নৃত্য করে কাঁপায় আমাকে।
আমি তার মৃতদেহ সযত্নে টাকার মতো
বেদনার বাক্সে তুলে রাখি।
তারপর একটি মুহূর্ত আসে, যখন নিজের কাছে
আমি নিজে ধরা পড়ে যাই–; একটি সময় আসে
যখন সন্ধ্যা নামে, বিশ্বাসের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে
জনৈক আল্লার বান্দা উঠে যায় আকাশের দিকে–
সমুদ্রের শঙ্খ ডাকে অঘ্রানের শীতল বাতাসে।
আমি চোখের সমস্ত দৃষ্টি মেলে আকাশে ঈশ্বর খুঁজি,
ক্ষীণকণ্ঠে পাখি দেখে বলে উঠি :
‘এই ভগবান, আমাকেও পাখা দাও,
তোমাকে বিশ্বাস করি, বন্ধুরা নাস্তিক জানে,
সুতরাং বলো না তাদের, কিছু কিছু রূঢ়-সত্য
সংগোপনে সংরক্ষিত রবে আমাদের কোনো কোনো
জীবনের কাছে আজীবন।’
একজন জানতে চেয়েছে, ভগবান কি আছেন?
আমি ব্যঙ্গচ্ছলে তাকে খুশি করে বলেছি : ‘ব্রোথেলে।’
–তুমি জানতে চেয়েছো তোমাকে ভালোবেসে
এখনো আগের মতো দুঃখ পাই কিনা;
আমি হেসে হেসে কত সহজেই অকৃত্রিম কণ্ঠস্বরে
বলেছি; ‘পাগল!’ প্রথমটির জন্যে ক্ষমা চেয়েছি রাত্রে,
দ্বিতীয়টি তোমার সান্নিধ্যলোভে তোমাকে ঠকানো,
মিথ্যে বলা, কেননা সত্য শুধু অপ্রকাশ্যে জ্বলে।
মৈথুন শেষ হয়ে গেলে যেমন নিজেকেও অপ্রিয়-
-দোষী-অপরাধী মনে হয়;-অবসাদ সারা দেহে
টানায় তাঁবুকে, ঠিক সেরকমই ক্লান্ত অবসাদ
আমার কপাল জুড়ে আজ রাত বসে আছে
লোভী মৎস্য-শিকারির মতো জলহীন অতল-পুকুরে।
মৎস্য কি শয়ন করে চোখ বুজে ঘুমায় কখনো?
আমি সেই অতল জলের সত্য জেনে নিতে গিয়ে
একটি অনামা ঝিলে আজ রাত মৎস্যদের
প্রধান অতিথি। চারপাশে রূপচাঁদা, শীতমাখা মাছ,
যেন জীবনের অপরূপ আনন্দের মেলায় এসেছি আমি,
এভিনিউ জানা নেই, সব স্ট্রীটে জলো অন্ধকার;
বাড়ির ঠিকানা চাই, কোন ব্লকে তুমি থাকো,
পাতালের কোন খাদে এমন সবুজ ঘাস জমে আছে।
পুষ্পিত লনে? কোনো কিছু জানা নেই,
বুঝি তাই এত পথ হেঁটে এসে ফিরে যেতে হবে
ব্যর্থতার মূর্ত কলরবে।
তোমাকে দেখার নামে তবুও তো দেখেছি অনেক,
জলের ভিতর দিয়ে সাঁতরে গিয়েছি চলে
সীমান্তের বলীরেখা ছিঁড়ে, যে ঘরে স্নানের শেষে
রমণী বদল করে অপবিত্র রাতের পোশাক
তার সে উলঙ্গ আভা, আঁশটেবিহীন দেহ
দেখেছি লুকিয়ে থেকে লেলিহান আগুন শিখায়।
তোমাকে দেখার নামে কুক্কুর আর কুক্কুরীর
অচ্ছেদ্য সঙ্গম দেখা হলো। মধ্যরাতে কলঘরে
জলের শব্দ শুনে প্রশ্ন জেগেছিল, এত শীতে
এত জল কার প্রয়োজন? তুমিও কি গতরাতে ছিলে
তার সাথে? তুমিও কি অবশেষে গর্ভে নিলে মানুষের
অমেয় সন্তান? তোমাকে দেখার নামে পুকুরে স্নানের শেষে
ঘরে ফেরা মায়ের গোপন মুখ ভেসে উঠেছিল।
এইসব স্মৃতি মনে এলে পাতায় পাতায় পড়ে
কবিতার বিন্দু শিশির। স্যাণ্ডেল আঁকড়ে-ধরা
পিচের শহর কথা বলে, ভোঁ ভোঁ করে ঘোরে,
গান গায়, রেডিওতে স্বরচিত কবিতা শোনায়,
কেউ কেউ কাঁদে, দুপুরে উইকেট পড়ে স্টেডিয়ামে,
বিকেলে সমস্ত সিটি জড়ো হয় চায়ের টেবিলে।
উঠতি চুলের মতো লতানো আঁধার নিয়ে রাত্রি নামে
বুড়ো নীলক্ষেতে। স্মৃতির খাদের ক্লেদে কী যেন
গিয়েছে ডুবে,–ভালোবাসা, মৃত্যু, প্রেম,
বরফের নিচের তিবেতে।