Poem

জীবনমধ্যাহ্ন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জীবন আছিল লঘু প্রথম বয়সে,
চলেছিনু আপনার বলে;
সুদীর্ঘ জীবনযাত্রা নবীন প্রভাতে
আরম্ভিনু খেলিবার ছলে।
অশ্রুতে ছিল না তাপ, হাস্যে উপহাস,
বচনে ছিল না বিষানল;
ভাবনাভ্রূকুটিহীন সরল ললাট
প্রশান্ত আনন্দ-উজ্জ্বল।

কুটিল হইল পথ, জটিল জীবন,
বেড়ে গেল জীবনের ভার;
ধরণীর ধুলি-মাঝে গুরু আকর্ষণ—
পতন হইল কত বার।
আপনার ’পরে আর কিসের বিশ্বাস,
আপনার মাঝে আশা নাই;
দর্প চূর্ণ হয়ে গেছে, ধূলি-সাথে মিশে
লজ্জাবস্ত্র জীর্ণ শত ঠাঁই।

তাই অজি বার বার ধাই তব পানে,
ওহে তুমি নিখিলনির্ভর!

অনন্ত এ দেশকাল আচ্ছন্ন করিয়া
আছ তুমি আপনার ’পর।
ক্ষণেক দাঁড়ায়ে পথে দেখিতেছি চেয়ে
তোমার এ ব্রহ্মাণ্ড বৃহৎ—
কোথায় এসেছি আমি, কোথায় যেতেছি,
কোন্ পথে চলেছে জগৎ।

প্রকৃতির শান্তি আজি করিতেছি পান
চিরস্রোত সান্ত্বনার ধারা।
নিশীথ-আকাশ-মাঝে নয়ন তুলিয়া
দেখিতেছি কোটি গ্রহতারা—
সুগভীর তামসীর ছিদ্রপথে যেন
জ্যোতির্ময় তোমার আভাস,
ওহে মহা-অন্ধকার, ওহে মহাজ্যোতি,
অপ্রকাশ, চিরস্বপ্রকাশ।

যখন জীবনভার ছিল লঘু অতি,
যখন ছিল না কোনো পাপ,
তখন তোমার পানে দেখি নাই চেয়ে,
জানি নাই তোমার প্রতাপ—
তোমার অগাধ শান্তি, রহস্য অপার,
সৌন্দর্য অসীম অতুলন—
স্তব্ধভাবে মুগ্ধনেত্রে নিবিড় বিস্ময়ে
দেখি নাই তোমার ভুবন।

কোমল সায়াহ্নলেখা বিষন্ন উদার
প্রান্তরের প্রান্ত-আম্রবনে,
বৈশাখের নীলধারা বিমলবাহিনী
ক্ষীণগঙ্গা সৈকতশয়নে,
শিরোপরি সপ্ত ঋষি যুগ-যুগান্তের
ইতিহাসে নিবিষ্টনয়ান,
নিদ্রাহীন পূর্ণচন্দ্র নিস্তব্ধ নিশীথে
নিদ্রার সমুদ্রে ভাসমান—

নিত্যনিশ্বসিত বায়ু উন্মেষিত উষা,
কনকে শ্যামলে সম্মিলন,
দূরদূরান্তরশায়ী মধ্যাহ্ন উদাস,
বনচ্ছায় নিবিড় গহন,
যতদূর নেত্র যায় শস্যশীর্ষরাশি
ধরার অঞ্চলতল ভরি—
জগতের মর্ম হতে মোর মর্মস্থলে
আনিতেছে জীবনলহরী।

বচন-অতীত ভাবে ভরিছে হৃদয়,
নয়নে উঠিছে অশ্রুজল—
বিরহ বিষাদ মোর গলিয়া ঝরিয়া
ভিজায় বিশ্বের বক্ষস্থল।
প্রশান্ত গভীর এই প্রকৃতির মাঝে
আমার জীবন হয় হারা—

মিশে যায় মহাপ্রাণসাগরের বুকে
ধুলিম্লান পাপতাপধারা।

শুধু জেগে উঠে প্রেম মঙ্গল মধুর,
বেড়ে যায় জীবনের গতি;
ধূলিধৌত দুঃখশোক শুভ্রশান্ত বেশে
ধরে যেন আনন্দমুরতি।
বন্ধন হারায়ে গিয়ে স্বার্থ ব্যাপ্ত হয়
অবারিত জগতের মাঝে;
বিশ্বের নিশ্বাস লাগি জীবনকুহরে
মঙ্গল-আনন্দধ্বনি বাজে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Author Bio

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায়

More

This post views is 27

Post Topics

Total Posts

469 Published Posts