Poem

রাজার ছেলে ফিরেছি দেশে দেশে
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
যেখানে যত মধুর মুখ আছে
বাকি তো কিছু রাখি নি দেখিবার।
কেহ বা ডেকে কয়েছে দুটো কথা,
কেহ বা চেয়ে করেছে আঁখি নত,
কাহারো হাসি ছুরির মতো কাটে
কাহারো হাসি আঁখিজলেরই মতো।
গরবে কেহ গিয়েছে নিজ ঘর,
কাঁদিয়া কেহ চেয়েছে ফিরে ফিরে।
কেহ বা কারে কহে নি কোনো কথা,
কেহ বা গান গেয়েছে ধীরে ধীরে।
এমনি করে ফিরেছি দেশে দেশে।
অনেক দূরে তেপান্তর-শেষে
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে এসেছি দিয়ে মালা।

একদা রাতে নবীন যৌবনে
স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,
বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার
ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া।
শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,
পূর্বতটে হতেছে নিশি ভোর।
আকাশ-কোণে বিকাশে জাগরণ,
ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর।
সমুখে পড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
দু-ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,
নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে
আপন মনে ভাবিনু একবার—
আমারি মতো আজি এ নিশিশেষে
ধরার মাঝে নূতন কোন্‌ দেশে,
দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা
স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা।

অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,
কত যে দেশ-বিদেশ হনু পার।
একদা এক ধূসর সন্ধ্যায়
ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার।
সবাই সেথা অচল অচেতন,
কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,
নদীর তীরে জলের কলতানে
ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি।
ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,
নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে।
প্রাসাদমাঝে পশিনু সাবধানে,
শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে।
ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,
কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা;
একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,
ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা।

কমলফুলবিমল শেজখানি,
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি
শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে;
একটি বাহু বক্ষ-’পরে পড়ি,
একটি বাহু লুটায় এক ধারে।
আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,
কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি;
পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি।
দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি—
ঘুমের দেশে স্বপন একখানি,
পালঙ্কেতে মগন রাজবালা
আপন ভরা-লাবণ্যে নিরালা।

ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,
না মানে বাধা হৃদয়কম্পন।
ভূতলে বসি আনত করি শির
মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন।
পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,
তাহারি পানে চাহিনু একমনে,
দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন
কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে।
ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়া
লিখিয়া দিনু আপন নামধাম।
লিখিনু, “অয়ি নিদ্রানিমগনা,
আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম।”
যতন করি কনক-সুতে গাঁথি
রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি।
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Author Bio

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে “গুরুদেব”, “কবিগুরু” ও “বিশ্বকবি” অভিধায়

More

This post views is 233

Post Topics

Total Posts

469 Published Posts