Poem

অ্যালেনের জন্যে এলিজি

শামসুর রাহমান

অ্যালেন, তোমার শেষশয্যা প্রথার শাসন মেনেই
রচিত হয়েছে, সমাধিস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল না কোনও দ্রোহ।
অ্যালেন, তোমাকে কখনও দেখিনি, অথচ আজ আমি
একান্ত আপন কারও বিয়োগ বেদনায় বিদীর্ণ। আমি
একেবারেই তোমার মতো নই ব’লেই হয়তো
তোমার জন্যে আমার পঙ্‌ক্তিমালা স্পন্দিত হচ্ছে
করুণ সুরে। অনন্তের বিউগলের নিঃসীম, নির্জন ধ্বনির ভেতর দিয়ে
অন্তর্ধান হ’ল একজন কবির। একটি শোকবার্তার মেঘময়তায়
নত মাথায় দাঁড়িয়ে গেলেন নানা দেশের কবি। শোকপ্রবাহে
কিছুক্ষণের জন্যে আমেরিকার বৈশ্বিক, বৈশ্যিক বহুরূপী সন্ত্রাস ভেসে যায়।

অ্যালেন, স্বজন আমার, তুমি তো জানতে
একজন কবির মৃত্যু হ’লে নিসর্গ কেমন বেদনা-বিহ্বল হয়।
মরণ তোমাকে হরণ করার পর গ্রীনউইচ পল্লী, নিউ ইয়র্কের
নিগ্রো স্ট্রিটনিচয়, তোমার নিজস্ব ত্র্যাপার্টমেন্ট, আড্ডাবাজ কাফে,
টমকিন্স স্কোয়ার, পার্ক, মুর্যমুখী, মকিং-বার্ড, ব্লেকের রুগ্ন গোলাপ,
তোমার ছোট হার্মোনিয়াম আর যশোর রোড-সবাই করে বিলাপ।
অ্যালেন, কী ক’রে যে দেখতে পেলাম একজন নুলোকে
চাঁদের সাইকেলে চ’ড়ে ঘুরে বেড়াতে মেঘের ফুটপাথে,
তুমি নিশ্চয় বুঝবে; তুমি নিখাদ বিশ্বাস করবে,
আমি অজ্ঞাত এক কুষ্ঠরোগীর বীজাণু-খোবলানো
বিপন্ন মাথায় সন্তের জ্যোতির্বলয় দেখেছি।
অ্যালেন, এই আমি এক গলির ঝলসিত গ্রীষ্মের দুপুরে
কর্কশ অন্ধকারে শহরের করোটির পুষ্পহীন চত্বরে
জেনারেটারের ক্রেংকারে শুনতে পাচ্ছি দেবদূতের গান।

অ্যালেন, তুমি কবিতায় লাভাস্রোত বইয়ে দিয়েছ; কত শব্দ
নিয়ে এসেছ আকাশের কারখানা থেকে। অজস্র
মোটরকারের গোরস্তান, এলএসডির সাইকেডেলিক জগৎ,
সাধুর ওম মন্ত্র, গাঁজার অন্তর্টান, শ্মশানের শ্যামা, লালন সাঁই
জুগিয়েছে তোমাকে কবিতার কণা। নিজের পুরনো জ্যাকেট, ট্রাউজার্স,
তরুণ বন্ধুর নগ্ন শরীর, ঘরের জানালা কিংবা বেসিন-
যেখানেই সপ্রেম হাত রেখেছ,
শব্দ কখনও পাথরের নুড়ি, কখনও আগুনের
টুকরো, কখনও-বা প্রজাপতির পাখনা হ’য়ে বেরিয়ে এসেছে;
শব্দ নিয়ে তুমি শৈব নৃত্যে মেতেছ, অ্যালেন।

অ্যালেন, হে সতীর্থ আমার, হে ফাঁপা, পতিত সংস্কৃতির নান্দীকার,
তুমি জ্বালা-ধরানো চড় কষিয়েছ নষ্ট সমাজের গলিত গালে,
অগ্নিশলাকা বিদ্ধ করেছ পুঁজিবাদের
নধর ভুঁড়িতে। তোমার কবিতা ‘চোপ ওর’ ব’লে
শাসিয়ে দিয়েছে বিধ্বংসী বোমাবাজ শাসকদের। জেনেছ,
শ্যামল বৃক্ষরাজির আত্মাহুতি, বিষক্রিয়ায়
অতিশয় কাতর নদীর যন্ত্রণার বিনিময়ে হাজার হাজার টনের
কাগজ দৈনিক বমি করছে আহত সভ্যতার খবর এবং
সকল মহাসাগরের মৃত্যুর আশঙ্কায়
আতঙ্কে পোড়া কাঠ হ’য়ে সন্তানের জন্মরোধের অঙ্গীকার করেছ।

অ্যালেন, হে প্রিয় কবি, বিদায়, তোমাকে বিদায়;
মৃত্যুকালীন তোমার অশ্রুকণাগুলো এখন
অনন্তের বুদ্বুদে বিলীন। তোমার অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই,
যদি বলি আজ তোমার কাব্যগ্রন্থে ধ্বনিত হচ্ছে দিব্যোন্মদ
ব্লেকের কণ্ঠস্বর, ঝরছে নিউ ইয়র্কের রোদ, শীতকুয়াশা আর
টলটল করছে বাংলাদেশের পদ্মপাতার জল। বিদায়, হে বন্ধু বিদায়।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 115

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts