Poem

আসুন আমরা আজ

শামসুর রাহমান

আসুন আমরা শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করি আজ,
আমরা সবাই যারা কেমন দৈবাৎ বেঁচে গেছি;
আসুন আমরা আজ নীরব দাঁড়াই যথারীতি
সকাতর কিছুক্ষণ লক্ষ লক্ষ মৃতের সম্মানে,-
আমাদের বহুকাল এমন দাঁড়াতে হবে বুঝি!
চলুন শামিল হই আজ শোক-মিছিলে সবাই,
পথে মেলি কালো বস্ত্র ‘ভিক্ষা দাও পুরবাসী’ বলে-
শহরে উঠুক বেজে শোকাতুর হারমোনিয়াম।

খোলা ছাদ, কবুতরময় মসজিদের গম্বুজ,
জীর্ণ বাস, গার্বেজের ডাম্প আর পোস্টার, ব্যানার,
নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো, পুরোনো পাঁচিল শোক নয়,
জ্যোৎস্নারাত, ফুটপাত, ডাকবাক্স, পিয়নের খাকি
জামা, নদী-নালা কিংবা পিয়ালের ডাল শোক নয়,
কচুরিপানাও নয়, বাবুইপাখির বাসা, সর্ষেক্ষেত,
নৌকোর নয়ন, ডুরে শাড়ি, অথবা নয়ানজুলি
শোক নয়; শোক জানি বাস্তবিক অবয়বহীন।

তবু শোক হয়ে যায় অকস্মাৎ অনেক কিছুই।
মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমার একান্ত ছায়াখানি
শোক হয়ে ব’সে থাকে এক কোনে, পথ হাঁটে আর
হাতের তালুতে বারবার দেখে নেয় জলোচ্ছ্বাসে
কর্দমাক্ত দ্বীপপুঞ্জ, জনপদ, উদগ্র শকুন।

চাদ্দিকে সতেজ ঘ্রাণ কাফনের; অনেক জায়গায়
দাফনের জন্যে কোনো লোক নেই। আমার পকেটে
দুটি মৃত গ্রাম্য শিশু, গলায় ঝুলছে যুব-লাশ,
আঙুলে জড়ানো লজ্জাবতী বিবস্ত্র বধূর চুল।
আমার হৃদয় হয় অগোচরে রুক্ষ মরুভূমি,
যোজন যোজনব্যাপী অতিশয় উদার শ্মশান।

ভোরে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সংবাদ প’ড়ে
আর ফটোগ্রাফারের একান্ত বাস্তবপ্রীতি দেখে
রেডিওতে কবিতা আবৃত্তি করে ডবকা দুপুরে
পঁয়ত্রিশ টাকার একটি সবুজাভ চেক নিয়ে
সিনেমার বিজ্ঞাপন, নির্বিকার ভিড় দেখে বাড়ি
ফিরি একা প্রতিশ্রুত চকোলেট ছাড়াই উদাস।
খেতে বসি, রাত হলে শুতে যাই, অভ্যাসবশত
নিবিড় জড়াই ক্লান্ত গৃহিণীর নিদ্রাপ্লুত গলা।
অকস্মাৎ খাঁ-খাঁ কাফনের ঘ্রাণে স্বপ্নের মধ্যেই
মেলায় হারিয়ে-যাওয়া বালকের মতো কেঁদে উঠি।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 118

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts