Poem

বিউটি বোর্ডিং

শামসুর রাহমান

আজকাল কোনো কোনো বিকেলে হঠাৎ কী রকম
হয়ে যাই, কী রকম এলোমেলো, যেন
আমার ভেতরে
কালবৈশাখীর মাতলামি, ভুলে যাই ইদানীং
আমার মাথার তিন ভাগ চুলে সাদার পোচড়া
পড়েছে, চোখের আলো বিকেলবেলার
মতোই স্তিমিত। বাসনার স্বপ্ন-ধোওয়া চরে নামে
আচাভুয়া পাখি, মাটি খুঁড়ে বের করে প্রত্ন হরেক রকম।

মনে পড়ে, একদা যেতাম
প্রত্যহ দু’বেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই
বিউটি বোর্ডিং-এ পরস্পর মুখ দেখার আশায়
আমরা ক’জন,
তখন তুমুল সময়কে
দিয়েছি গড়িয়ে স্রেফ চায়ের বাটিতে,
কখনো জ্বলন্ত পুণ্য ঝোপের মতন
মাথা আর জঠররাগ্নি নিয়ে
পড়েছি কবিতা শাপভ্রষ্ট দেবতার স্বরে। কখনও জুটেছে
ফুল চন্দনের ঘ্রাণ, কখনোবা হুল বেশুমার।
কোনো কোনো দিন ডাকে এলে দূর কলকাতা থেকে
বুদ্ধদের বসুর ‘কবিতা’ আমাদের চকচকে
চোখগুলি পড়ত হুমড়ি খেয়ে স্মল পাইকার
নান্দিনিক ভিড়ে আর স্পন্দিত হৃদয়ে দেখতাম কার কার
কবিতা পেয়েছে ঠাঁই কিংবা কার পদ্য
স্বর্গচ্যুত হলো সদ্য-পাওয়া সেই স্বপ্নিল সংখ্যায়।

কাউন্টারে শ্রীযুক্ত প্রহ্লাদ তার একটি খোটো পা
দোলাতেন মৃদু স্বরবৃত্তের মতন, লিখতেন
কালো বেঁটে কলমে লম্বাটে
খাতায় হিসাব আর আমরা কানি বকের ছানার মতো
চায়ের পেয়ালা সামনে রেখে
উঠতাম মেতে
পাউন্ড স্পেংলার টোয়েনবি, মার্বস, উত্তর-রৈবিক
কবিতার দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে প্রত্যাগত
নাবিকের ধরনে এবং আমাদের
কত যে হাসির আলো মিশে গেছে গোধূলির বিনম্র আভায়।
একদিন হঠাৎ সকাল দশটায় শুনি বিউটির গৌর,
যুবক বেয়ারা, যৌন রোগী, ঝুলেছে ফাঁসিতে কাল মধ্যরাতে।

কতকাল যাই না সেখানে আর বিউটি বোর্ডিং-এ।
সেখানে যেতাম যারা আড্ডার সুরায়
চুর হতে, তারা কবে ছিটকে পড়েছে দশর্দিকে,
যেন ভালুকের থাবা
হঠাৎ ফেলেছে ভেঙে তন্ময় মৌচাক। আমি আর
দুরু দুরু বুকে
ঈষৎ কম্পিত হাতে সদ্যলেখা কবিতা কারুকে শোনাই না,
বরং নিজেই শুনি কোনো কোনো তরুণ কবির
আবেগার্ত পদাবলি কখনো-সখনো;
মহিলা কলেজে-পড়া তরুণীর সঙ্গে স্মিত হেসে
কথা বলি, অটোগ্রাফ খাতায় কলের
পুতুলের মতো সই দিই বিয়ে বাড়িতে অথবা
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হয়তো কেউ কেউ
আমার আড়ালে-আবডালে বলে ফিসফিসে স্বরে
‘ভদ্রলোকে তেমন যুবক নেই আর’।
যারা কথা ভেবে ভেবে একদা আমিও নীল প্যাডে
করেছি উজার থরথর
হৃদয় আমার আজ তাকে ভাবি ভাবলেশহীন,
দৈবক্রমে দেখা হলে তার পুত্র-কন্যার মাথায়
আদর ঝরাতে পারি অবলীলাক্রমে
ওদের পিতার কোনো সুহৃদের মতো।
ক্যান্সারের মতো দ্রুত বর্ধমান বয়স আমার।
কতকাল, কত দীর্ঘকাল
বিউটি বোর্ডিং থেকে নির্বাসিত আমি। কোনো দিন
আবার সেখানে ছুটে যেতে পারব কি
আষাঢ়ের বৃষ্টি-আঁচড়ানো অপরাহ্নে কিংবা কোনো
গনগনে ভাদ্রের দুপুরে? যাই যাই
কোনো কোজাগরী পূর্ণিমায়,
করোটির মতো সেই বিউটি বোর্ডিং-এ,
কৈশোরে আঁধারে ভূত দেখার মতন
ভয়ানক ভয় পাব আমি?

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 174

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts