Poem

ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ

শামসুর রাহমান

ক’জন ছায়া আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন
নৈশ ভোজে এক গুহায়, যার দেয়ালে ক্ষ্যাপা
কোনো শিল্পী মনের খেয়ালে ভয়ঙ্কর সব চিত্র
এঁকে রেখেছেন। কালো পাথরের গোল টেবিলে
আমরা বসলাম কিছু দূরত্ব বজায় রেখে স্থূলকায় মোমবাতির আলোয়;
টেবিলে সাজানো বিচিত্র খাবার আর পানীয়।

ছায়াগণের কারো চক্ষুকোটরে কোনো চোখ নেই,
কারো বুকের ভেতর হৃৎপিন্ড নেই,
কারো নাক মুখ কিছুই নেই, কারো বা সারা শরীর জুড়ে
ধারালো অস্ত্রের আঘাত, কারো
দুটো হাতই কাটা এবং একজনের মাথার খুলির
অর্ধেকটাই গায়েব। আমার পায়ের কাছ ঘেঁষে
একটা হোঁৎকা ইঁদুর কোথায়
ঢুকে গেলো চোখের পলকে। দেখি মাথার ওপর
ঝুলে আছে এক ঝাঁক রক্তচোষা বাদুড়।
আমার ছায়া স্থির হয়ে রয়েছে
গুহার দেয়ালে। আমি কি ভয় পাচ্ছি? নাকি
লুপ্ত হয়েছে এই অদ্ভুত পরিবেশে আমার বোধশক্তি?

একজন ছায়া, যার চক্ষুকোটর শূন্যতায় খাঁ খাঁ,
বললেন ক্ষতার্ত স্বরে, “আমি মানুষের অসুস্থ চোখ
সারিয়ে তোলার সাধনায় মগ্ন ছিলাম,
অথচ ওরা আমার জ্বলজ্বলে দুটি চোখ উপড়ে ফেলে
হত্যা করেছে আমাকে। কিন্তু আজ ওরা তোমাদের
চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আস্ফালন করছে যত্রতত্র।
তোমরা ওদের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছ ক্রমাগত।“ আমি
তাঁর কথার জবাব না দিতেই
আরেকজন ছায়া, যাঁর মুখ শনাক্ত করা যাচ্ছিল না,
কিন্তু কণ্ঠস্বর খুবই চেনা, “আমি অনেককে
সাহিত্য পড়িয়েছি বিশ্বাবিদ্যালয়ে; সত্য, শিব এবং সুন্দরের
তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছি। দ্যাখো, আমাকে ওরা হত্যা করেছে
তরুণ তরুণীদের মনে সত্য, কল্যাণ এবং সুন্দরের আলো
পৌঁছে দেওয়ার অপরাধে। অথচ তোমরা,
হ্যাঁ তোমরা ওদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছ কী সহজে, কথা বলছ
এক টেবিলে ব’সে। তুমি কবি, তুমি আমার,
আমাদের মনোবেদনা উপলদ্ধি করবে। দ্যাখো, ভালো ক’রে দ্যাখো,
কী হাল ওরা করেছে আমাদের পঁচিশ বছর আগে।“

হঠাৎ আমি নিজেই যেন ছায়া হ’য়ে ছায়া-ছায়া স্বরে
সেই অতি পরিচিত কণ্ঠস্বরের উদ্দেশে বলি,
“আমি সামান্য এক কবি, কী সাধ্যি আমার
দুর্জনদের দমন করার। হে গুরু, হে ভ্রাতা আমার,
আপনি তো ভালোই জানেন ঘাতকের মারণাস্ত্রের মুখে
কবির কলম কত অসহায়। নিজের প্রাণ দিয়েই তো আপনি
সেই সত্য জেনে গেলেন। আপনার
হাতেও তো ছিল নন্দিত লেখনী, বিশিষ্ট কণ্ঠে দীপ্ত ভাষণ।
যাদের ওপর ইতিহাসের চাকা ঘোরানোর ভার,
তারাই যখন বিস্মৃতির ডোবায় ডুবিয়েছে আপনাদের আত্মদান,
তখন এই আমি, যার রথের চাকা দেবে গ্যাছে
কাদায়, কী আর করতে পারি অরণ্যে রোদন ছাড়া?”

বেশ কিছুক্ষণ পর সেই গুহায় ব্যেপে আসে ক্ষমাহীন বিস্তব্ধতা,
স্থুলকায় মোমবাতিগুলো গ’লে গ’লে
নিঃশেষিত-প্রায়, একটি প্যাঁচা ড্যাবড্যাবে চোখে
তাকিয়ে আছে আমার দিকে, ছায়াগণ আগেই
করেছেন প্রস্থান। এখন আমার পুঞ্জীভূত ব্যর্থতা
আমাকে ঘিরে জুড়ে দিয়েছে
প্রেতনৃত্য, পাখা ঝাপটাচ্ছে বাদুঁড় আর আমার
চোখের নিচে বাটিতে পঁচিশ বছরের শ্যাওলার স্যুপ জুড়িয়ে বরফপানি!

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 106

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts