Poem

এখন আমার শব্দাবলি

শামসুর রাহমান

ছিলো তো সোনালি সমঝোতা, তবু কেন বেঁকে বসে
আমার নিজস্ব শব্দাবলি?
কখনও তোয়াজে রাখি, কখনও-বা ওদের সম্মুখে
প্রেমিকের মতো সানুরাগ নতজানু আমি। আর
গন্‌গনে দুপুরে ওদের যত্নআত্যি করি চামর দুলিয়ে ঘন ঘন,
যখন প্রবল নামে শীত,
ব্যাকুল বাঁচিয়ে রাখি আপাদমস্তক
শীতবস্ত্রে ঢেকে।

কখনও খাওয়াই দুধকলা, অসুখের আন্দেশায়, পার্কে কিংবা
নদীতীরে খানিক বেড়িয়ে নিয়ে আসি,
চাবুক চালাই খুব সপাং সপাং মাঝে মাঝে,
যেন সার্কাসের শ্বাপদের ট্রেইনার।

এখন আমার শব্দাবলি নিরিবিলি স্মিত ঝিলে পা ডুবিয়ে
হরিণের মতো চোখ তুলে তাকায় না, দাঁড়ায় না
খড়ের গাদার পাশে চকচকে ঘোড়ার মতন
বাঁকিয়ে তরুণ গ্রীবা, দোলে না কেশররাজি হাওয়ায় স্পন্দিত
শস্যের ধরনে আর। এখন আমার শব্দাবলি অগাধ জ্যোৎস্নায়-পাওয়া
পরীদের মতো নয় নৃত্যপরা। টাইপরাইটরের বিশদ কীবোর্ড
ছিটোয় না উচ্ছসিত গোলাপ এখন। বাণিজ্যিক এলাকায়,
ফুটপাতে, বনেদি পাড়ায়, ফ্লাটে ফ্লাটে
কিংবা কোনো বিবর্ণ বস্তিতে
আমার নিজস্ব শব্দাবলি
রক্তচক্ষু কোকিলের মতো গেয়ে ওঠে না এখন।

সকল পাখির কণ্ঠে জমাট বেঁধেছে চাপ চাপ
তুষার, তাদের ছিন্নভিন্ন
পালক এখানে ওড়ে ইতস্তত এবং অস্বস্তিকর মৌন
ঝুলে রয় চতুর্দিকে বিরতিবিহীন, এ প্রান্তর অতিশয়
ক্লিষ্ট, গমগিন, এমনকি মাতমেরও ধ্বনি নেই।
রজনীগন্ধার বন ফুঁড়ে বেরোয় কেবলি শীর্ণ, প্রসারিত
হাত, অগণিত বিক্ত, মূক ও বধির।
হঠাৎ দুপুরে সন্ধ্যা, মানুষের ত্রাতা তাঁর পেরেক-চিহ্নিত
রক্তাপ্লুত হাতে খুঁজছেন খাদ্যকণা বার বার
কুকুর-শাসিত ডাস্টবিনে, তিনটি মলিন হ্রস্ব
নোটের বদলে মেরি-মাতা নির্দ্বিধায়
রাত্তিরে হচ্ছেন ম্লান, হাতে উল্কি আঁকা, একচক্ষু
নাবিকের আস্তানায় এবং রবীন্দ্রনাথ কালোবাজারির
দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল
ভিক্ষা চাইছেন ত্রঁটো-কাঁটা মাথা নত করে আর
তিন দিন তিন রাত্রি উপোসের পরে ফুটপাতে
এক ভিড় লাশের পাশেই ভাঙা উজাড় থালায়
দেখছেন অলৌকিক ভোজ নজরুল ইসলাম।

কী করে আমার শব্দাবলি একরাশ
পাতার আড়াল থেকে রক্তচক্ষু কোকিলের মতো
গান গেয়ে ওঠবে এখন?

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 101

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts