Poem

একটি বালকের জন্যে প্রার্থনা

শামসুর রাহমান

ভীষণ বুড়িয়ে গেছি ইদানীং আমরা সবাই,
বেশ জবুথবু লাগে নিজেদের বেলা-অবেলায়।

আমরা সবাই বুড়ো। কেউ পঙ্গু বাতে, শয্যা কারো
মালিশের গন্ধে ভরা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত কেউ আর
আদিম গুহার মতো দন্তহীন মুখ খুলে কেউ
বিড়বিড় বকে সারাক্ষণ-বকুনির আগাগোড়া
বাপের আরবি ঘোড়া দাদার ইরানি তাঞ্জামের
ঝিলিমিলি জুড়ে রয়। বারান্দার দাঁড়বন্দি তোতা
সেই বকবকানির ধৈর্যশীল শ্রোতা। তার কী-বা
দায়, ঝুঁটি নাড়ে, ছোলা খুঁটে খায়, বহুবার শোনা
কাহিনীর করে কথকতা। বুকে টুকটুকে ঠোঁট
গুঁজে রাখা, ঘুম পেলে। নিজেদের মতো হতে চেয়ে

ক্রমান্বয়ে শুধু অন্য কারুর মতোই হয়ে যাই
নিজেরই পার্টের বদলে ভুল পার্ট আওড়াতে
আওড়াতে ক্লান্ত হই। যতই ভুগি না কেন বাতে,
রক্তচাপে, রক্তে রক্তে শর্করার প্রকোপ যতই
যাক বেড়ে, জীবনকে প্রতিদিন মনে হয় তবু
হাড়হিম শীতে সুশোভন পশমের কম্ফর্টার
গলায় জড়ানো, তাই সকালে বিকালে প্রকৃতির
খোলামেলা দরবারে আয়ুর মেয়াদ বাড়ানোর
ব্যাকুল তদ্বির নিয়ে যাই। ভদ্রয়ানা মজ্জাগত
এবং প্রজ্ঞার ভারে দু’হাটুতে ঠেকে সাদা মাথা,
অথচ চৌদিকে কী-যে ঘটে দিনরাত কিছুতেই
ঢোকে না মাথায়। অভ্যাসের দাস বলে প্রতিদিন
সংবাদপত্রের ভাঁজ খুলি আর চোখের অত্যন্ত
কাছে নিয়ে হেড লাইনের মায়ায় বেবাক ভুলি!

লাঠি যেন প্রাণাধিক পুত্র, তাই কম্পমান হাত
কেবলি তাকেই খোঁজে। পাড়ায় হাঙ্গামা বাধলেও
তেমন পাই না টের, আজকাল শ্রুতির প্রাখর্য
বলতে কিছুই নেই। বরং কালাই বলা চলে,
বদ্ধ কালা! হামেশাই খুব পুরু কাচের চশমা
পরি, তবু লোকজন, ঘরবাড়ি, পাড়া কি বেপাড়া,
অলিগলি, গাছপালা স্পষ্ট আর দেখি না কিছুই।

আমরা সবাই বুড়ো, দৃষ্টির স্বচ্ছতা নেই কারো।
আমরা সবাই আজ একটি বালক চাই যার
খোলা চোখে রাজপথে নিমেষেই পড়বে ধরা ঠিক
সেই রাজসিক মিহি কাপড়ের বিখ্যাত ছলনা।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 145

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts