Poem

এমন ঠেলতে ঠেলতে

শামসুর রাহমান

আজ
তুমি আমাকে
এমন ঠেলতে ঠেলতে
এ কোথায় নিয়ে এসেছ ঢাকা,
হে শহর আমার?
তোমার কনুই আমাকে
পৌঁছে দিয়েছে, বলা যায়,
প্রায় উপকণ্ঠে।

তোমার পুরানো সৌন্দর্যে
অভিভূত আমি
ভালোই ছিলাম, একথা
অস্বীকার করব কী করে?
নানা ফাটল-খচিত এক বাসায়,
ইঁদুর, ছুঁচো, চামচিকা আর মাঝে-মধ্যে
আরশোলার ওড়াউড়ি
হয়ে গিয়েছিল গা-সওয়া।
হেমন্তে চড়ুই দম্পতি
বাসা বাঁধত ঘরের ভেতরে।
খড়কুটোয় নোংরা হতো মেঝে,
কখনো-সখনো পাখির সংসারের
কণা এসে পড়ত মাথায়,
মাথা নেড়ে মেনে নিতাম
সেই উপঢৌকন। কোনো কোনো
অতিথি বলতেন, ‘বেশ আছেন কবি।
আমি কাঠের বর্গার
ফাঁক-ফোকরের দিকে
দৃষ্টি মেলে দিয়ে একটু হেসে
সায় দিতাম তাঁদের উক্তিতে।

হ্যাঁ, বেশ ছিলাম, ঢাকা, শহর আমার,
কলতলার জটলা, নড়বড়ে চা-খানা
আর মাতালের চিৎকারে শিউরে ওঠা
রাতের গলিতে, ফিল্মি গানের ভেসে-আসা কলিতে
মৌজে-থাকা মাস্তানদের
আড্ডার হৈ-হল্লা
আর তেহারির ঘ্রাণে, ডাস্টবিনের
আশপাশে কুকুর, বেড়ালের
সম্মেলনে, দিব্যি ছিলাম।

কিন্তু তুমি আমাকে
হঠাৎ পাঠিয়ে দিয়েছ
তোমার হৃদয় থেকে অনেক দূরে।
নির্বাসিত কবির মতো
আমি দিন কাটাই,
রাত্রি যাপন করি,
অথচ আমার মন পড়ে থাকে তোমার
পুরানো রূপের গভীরে।

আজ রাত্তিরে কিছুতেই
আমার ঘুম আসছে না। নিঝুম
পাড়া, হয়তো কোথাও কোনো
ছিঁচকে চোর ওৎ পেতে আছে,
আমার জানলার পাশে নারকেল
গাছে দেবদূতের দোলা। কেন জানি না
নিজের গোটা জীবন
উঠল দুলে
আমার দৃষ্টিপথে। কত চড়াই-উৎরাই,
পুকুরে মাছের ঘাই, সকালবেলা
মোরগের ডাক, পাখির শিস,
নীল প্যাডে চিঠি, দুপুরে
ভাঙা মন্দিরের ছায়া,
ঘোড়ার গাড়িতে নগর ভ্রমণ,
মধ্যরাতে টেলিপ্রিন্টারের শব্দ,
কবিতার কচ্ছপ কামড়, প্রেমের রাজ্যে
জব্দ, অর্ধচন্দ্র খেয়ে বিদায়, অকস্মাৎ ধুমধাড়াক্কার
ফুলশয্যা, অনিয়ন্ত্রিত জন্ম;
মার্কস আর ফ্রয়েডের সহাবস্থানে আস্থা,
সামরিক শাসনে কারো আস্থা কারো বা অনাস্থা, রেড বুকের
সূত্র আওড়ানো, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার
হুইল চেয়ারে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা।
খানাখন্দে মানবতার হুমড়ি খেয়ে পড়া,
শিকারির গুলিতে পালকখসা গণতন্ত্রের পতন,
শিরাস্ত্রাণের উত্থান!
ঢাকা, হে শহর আমার,
ঠেলতে ঠেলতে আমাকে
এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি?
তোমার চতুঃসীমা থেকে,
একেবারে বাইরে ফেলে দেবে না তো?
পড়বে না জেনে বুক শেল্‌ফ
হাতড়ে বেড়াই, তাকে তুলে-রাখা
গুরুমুখী লাল বইয়ে
ধুলোর আস্তরণ, মগজে ভ্রমণের গুঞ্জন, অন্ধকারে
দৃষ্টি ছড়িয়ে ভাবি,-
আমার প্রতিবেশে
থরেথরে শত ফুল ফুটবে কবে?

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 114

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts