Poem

ফেরা না-ফেরা

শামসুর রাহমান

একদা এখানে দাঁড়িয়ে সে দু’ঘণ্টা লাগিয়ে দাড়ি
কামাতো এবং স্নান সেরে তাড়াতাড়ি
আঁচড়াতো চুল। তাকে দেখতে ভালোই ছিল, তার
চুল ছিল কালো আর ঘন,
প্লাস্টিকের চিরুনিটা কখনো কখনো
ভাঙবার
উপক্রম হতো, এই টেবিলে দু’বেলা তৃপ্তি নিয়ে
করতো আহার মাছ, মুড়িঘন্ট দিয়ে
সকলের সঙ্গে, গল্প-গুজবেও উঠতো মেতে
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে।
দেখতো তাকিয়ে দূরে মাঝে-মধ্যে বাগানের ফুলের বাহার,
কখনো শুনতো মগ্ন বেলায়েত খানের সেতার।

গাছের পাতায়
পড়লে বৃষ্টির ফোঁটা সন্ধ্যেবেলা, রাত্তিরে, মাথায়
স্তূপ স্তূপ মেঘ ঢুকে যেতো তার, মনে
পড়তো সুদূর গুহা, বাকল-সজ্জিতা তীক্ষ্ণ কনে
কবেকার। হরিণের পেছনে ছোটার
উদ্দামতা আবার শিরায় শত নক্ষত্র ফোটার
প্রাক্তন শিহর দিতো জ্বেলে;
ফের দৃষ্টি মেলে
গৃহকোণে হো হো করে উঠতো নিভাঁজ হেসে, যেন অর্থহীন
সব কিছু, এমন ভঙ্গিতে পাশ ফিরে
শোয় বিছানায়; ভোরে পুনরায় অমলিন
মুখে নামে পৌরপথে, যায় অফিসে এবং মিশে যায় ভিড়ে।

অকস্মাৎ বলা-কওয়া নেই একদিন
ঠিকানা না রেখে হলো সে উধাও, যেন হাওয়ায় বিলীন
হয়ে গেল জাদু বলে। তারপর গিয়েছে গড়িয়ে
পুরোপুরি পনেরো বছর। মাতৃক্রোড়ে বসে আয় আয় টিয়ে
বলতো যে-শিশু সে এখন
কার্ল মার্কস পড়ে সুদিনকে ডাকে আর দেয় মন
নিসর্গ নারীতে আর রাজনীতিতে আকণ্ঠ মজ্জমান,
কখনো কখনো গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান।
পনেরো বছর পরে এল ফিরে বসতবাটিতে
কী খেয়ালে; চোখে মুখে ছিটে
লাগে অতীতের, বসে পুরানো চেয়ারে পুনরায়,
দাঁড়ায় আয়নার পাশে, দাড়ি কাটে, চুল আঁচড়ায়,
অথচ আঁচড়াবার মতো
বেশি চুল নেই আর। নজরের আলো ক্ষীণ, ক্রমাগত
কী এক খটকা এসে বেবাক ভণ্ডুল
করে দেয়। যেন অন্য কারো অতিশয় ভুল
মুখ নিয়ে করে চলাফেরা, কেউ তাকে
পারে না সহজে নিতে। সব কিছুতেই গূঢ় অন্তরাল থাকে
কখন যে কাকে ডাকে থাকে না খেয়াল!
বস্তুত দেয়াল
এক তার আর অন্যদের মাঝে গড়ে
ওঠে, অর্থহীন বৃত্তে ঘোরে
সারাক্ষণ ভুল পদক্ষেপে, মুখ কালো
করে ভাবে এতকাল পরে না ফেরাই ছিল ভালো।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 83

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts