Poem

ফ্ল্যাশব্যাক এবং …

শামসুর রাহমান

শৈলাবাস, যা স্যানাটরিয়ামও বটে, ভিড়াক্রান্ত। এখন সেখানে প্রজ্ঞা
ভীষণ শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তপ্ত শলাকা দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে
বিবেকের চোখ; উপরন্তু ওর হাতে ভারী শেকল, পায়ে বেড়ি। বোধি
নির্বাসিত। মিথ্যার বারফট্রাই আর মাস্তানিতে সত্য গা ঢাকা
দিয়েছে। আমাদের কোনও কোনও স্বপ্ন বিশ্বাসঘাতকতায়
মেতে আমাদের বিদ্রূপ করে যখন তখন। এখানে অনেকে
একজনের নাম বলতে গিয়ে দিব্যি অন্যজনের নাম উচ্চারণ করে
সগৌরবে। সেজন্যে কারও বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই। অনুশোচনা তো
অনেক আগেই বেপাত্তা। পাড়াপড়শিরা শরমের মাথা খেয়ে বরং
কোমরে ঘুনসি এঁটে হাসির গিটকিরি ছড়ায় চৌরাস্তায়।
ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ঢের হ্যাপা আছে জেনে বড় মেজো সেজো অনেকেই
দল বদলের রঙে মাতোয়ারা, অনেক জাঁকালো চণ্ডীমণ্ডপের
ফরাসে বসে ফরাসি টানে। কেউ কেউ দেশ অ্যাকোরিয়াম হোক,
এই মতো স্বপ্ন দ্যাখে ভয়ে ভয়ে।

কয়েকটি কলহংস-শব্দ বাড়িটার পাছদুয়ার দিয়ে ভেতরে
আস্তেসুস্থে প্রবেশ করে। কলহংসগুলোর শরীরে রৌদ্র-জ্যোৎস্না,
জল-হাওয়ার দাগ, দীর্ঘশ্বাসের ছায়া কম্পমান। শেষ রাতের
প্রহরকে চমকে দিয়ে মীরা বাঈ-এর ভজনস্নিগ্ধ হাতের কঙ্কন
নগ্ন মেঝেতে গড়ায়। ছাদ, দেয়াল, সিঁড়ি মেঝে ফুঁড়ে
রক্তের ফোয়ারা। আলাওলের পুঁথি আর রবীন্দ্র রচনাবলী
রক্তবমনে অচেতন। আলাওলের পদ্মাবতী রক্তস্নান সেরে ওঠে গভীর
গভীরতর বেদনায়। সারা গায়ে আনারের দানার মতো রক্তফোঁটা
নিয়ে হু হু বুকে লেকের কিনারে ছুটে যায় ‘পদ্মাবতী’র কবির রাজহাঁসের
পালকে বানানো লেখনীর সঙ্গে জলে সহমরণের অভিলাষে। রক্তভেজা
অচিন পাখিকে দেখে ছেঁউড়িয়াতে আচমকা ছিঁড়ে যায় লালনের
একতারার স্তব্ধ অথচ সপ্রাণ তার।
অতিকায় এক সোনালি দেয়ালের পিঠ থেকে নেমে আসেন তিনি। তাঁর
চোখে যুগপৎ বেদনা আর কৃতজ্ঞতার অশ্রুকণা চিক চিক করে
শ্রাবণের শেষ রোদে। ক্ষতবিক্ষত মানচিত্রের মতো বুক চেপে তিনি
দেখছেন কি দ্রুত তাঁর প্রাণের বাংলাকে এক প্রকাণ্ড পাগলা
গারদে রূপান্তরিত করা হয়েচে। এখানে সবাই বড় বেশি
স্বাভাবিক সুস্থতার নাটুকে ঢঙ দেখিয়ে চলেছে। একটা বদ
হাওয়া এতকাল আচ্ছন্ন করে রেখেছে স্বদেশভূমিকে। দেখা
যাক, মনে মনে বলেন তিনি, আমার উত্তরাধিকার অতীতাশ্রয়ী
না হয়ে সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে কিনা। সারাক্ষণ শুধু
অতীতের দিকে মুখ রেখে চললে প্রগতির চাকা ডোবে
পিছল কাদায়। আমার উত্তরাধিকার পেছনে কিংবা সামনের
চোরাবালিতে পা রাখলে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হবেই হবে
স্বজনেরই হাতে।

অনন্তর তিনি অপেক্ষমাণ সোনালি দোয়েলটির দিকে খানিক
তাকালেন, তাঁর চোখে একটি প্রশ্ন নক্ষত্রমালা হয়ে
দুলতে থাকে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 98

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts