Poem

শীতসন্ধ্যায় একা-একা হেঁটে যাচ্ছিলাম ফুটপাতে
সুপার মার্কেটের ধার ঘেঁষে। কোথাও
জনমানুষের সাড়া নেই; দোকানপাট, পেট্রোল পাম্প,
ঘরবাড়ি, লেক, গাছপালা
সবকিছু ভারী নিদ্রাতুর। একস্মাৎ কী-যে একটা
ছুঁয়ে গেল আমাকে।
চমকে দেখি, কেউ কোথাও নেই, বাতাসও নয়
সঞ্চরণশীল; আমার ভেতর
এক কম্পন, গুনীর আঙুলে সেতারের তার।
কিছু কথা আমাকে স্পর্শ করার বাসনায় কম্পমান।

শহদীদের কি স্পষ্ট কোনও কণ্ঠস্বর আছে?
কোন্‌ ভাষায় কথা বলে ওরা?
যে ভাষায় ভাসমান মেঘের টুকরো শহুরে পথে
দাঁড়ানো বিরল গাছের পাতা, ডাগর
নদীর বাঁক অথবা কুয়াশা কথা বলে,
সেই ভাষাই কি ভর করে শহীদদের কণ্ঠহীন কণ্ঠে?

কী ওরা বলতে চায়? কান পেতে থাকি,
হাঁটার ছন্দ হোঁচট খায়। নক্ষত্রের গুলজার আড্ডায়
চোখ রাখি, ফিস্‌ফিসানি
গর্জন হ’য়ে ফেটে পড়ে ফুটপাতে, ভড়কে
থমকে দাঁড়াই। শহীদদের জোরালো কোরাস
শুনতে পাই, “পথচারী, জবাব দাও। আমাদের যারা
হত্যা করেছে দিনদুপুরে,
তাদের বিচার কেন ঘুমিয়ে আছে লাশকাটা ঘরে?
আমাদের স্বপ্ন যারা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে বুলেটে,
আমাদের আপনজনের চোখ আজো ভাসছে শোকাশ্রুতে
যাদের তাণ্ডবে,
তারা কেন থাকবে বিভোর সুখনিদ্রায়?
জবাব দাও পথচারী, জবাব দাও।

আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের, যারা
মৃত্যু-খচিত নক্‌শা তৈরি করেছে,
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের, যারা
আমাদের ঘরে ভ’রে দিয়েছে অন্তহীন মাতম।
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের,
যারা মনুষ্যত্বের গা’ থেকে তুলে নিয়েছে চামড়া।
জবাব দাও, কেন শাস্তি হবে না সেই অপরাধীদের?’
নিরুত্তর আমার দাঁড়িয়ে থাকা শীতসন্ধ্যায়
একঠায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবি,
শহীদদের একরোখা কোরাস আমাকে চাবকাবে
কতকাল? অসহায় কবিকে কেন করতে হবে জবাবদিহি?
শহীদদের কণ্ঠস্বর সহজে আমাকে
ছেড়ে যায় না, লেপ্টে থাকে প্রতিটি নিশ্বাসে,
আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেসব সড়কে,
যেখানে ব’য়ে গেছে প্রতিবাদী রক্তধারা।
জেগে গেছি, হত্যাকারীরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত
শহীদদের কণ্ঠস্বর পথচারীকে শান্তি দেবে না।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 91

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts