Poem

কিছু বাতিল কাগজ

শামসুর রাহমান

প্রায়শই খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে বসাই নিজেকে
বিভিন্ন আসনে আর স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। নানা কোণ
থেকে দেখি নিজেকে, আবার জুড়ে দিয়ে
আমার আমাকে খুব কাছ থেকে সম্পূর্ণ সত্তার
আসল আদলটুকু নিবিড় পরখ
করে নিই অভিজ্ঞ দর্জির ভঙ্গিমায়।

এই যে লোকটা আমি হামেশাই বসে থাকি সামান্য চেয়ারে,
বই পড়ি, খবরের কাগজে বুলাই চোখ আর
অনেক সফেদ পাতা পঙ্‌ক্তিতে সাজিয়ে তুলি গভীর নিষ্ঠায়,
যখন আমার দিকে দৃষ্টি দেয় কেউ কেউ, তারা বিস্ময়ের ঢেউয়ে
ঢেউয়ে নড়ে ওঠে, কেউ কেউ ঠোঁট নিপুণ বেঁকিয়ে
উপেক্ষার হাসি হেসে দূরে সরে গিয়ে বড় স্মার্ট ভঙ্গিমায়
হাঁটে, এই আমার ভেতরকার লোক
মাথার গভীর হ্রদে কিছু রঙিন মাছের খেলা মাঝে মাঝে
অনুভব করে লালনের তরিকায়-সেইসব মাছ কোন্‌ জাদুবলে
কবিতার পঙ্‌ক্তিরূপে খুব সন্তরণপ্রিয় হয়ে ওঠে।

অন্ধকার কাঁকড়ার মতো মতো হাঁটে চতুর্দিকে, তবু আলো খুঁজি,
যেমন নদের চাঁদ ঘুরে বেড়ায় একলা শূন্য নদীতীরে
আর বনবাঁদাড়ে ব্যাকুল মহুয়ার খোঁজে চোখে চোখ
রাখার সুতীব্র পিপাসায়। কণ্ঠ বিশুষ্ক ভীষণ।

মাঝে মাঝে কী বৈশাখে কিংবা মাঘে সামাজিকতায়
বড় বেশি মেতে উঠি। এ আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তবু কেন
এভাবে কাটাই ঢের সময়, বুঝি না। কখন যে
নিজের ভেতর ঘটে বিস্ফোরণ, কেঁপে উঠি ভয়াবহভাবে।

পরমুহূর্তেই ঠিক অদৃশ্য রবারে মুছে ফেলি খুঁটিনাটি
অতি দ্রুত। নীরবে টেবিলে ঝুঁকে কবিতার খাতা
খুলে বসি, মনের ভেতরে
কখনও ভ্রমর করে গুনগুন, কখনও বা জোনাকিরা জ্বলে
আর নেভে। ভিন্ন লোক হয়ে কলমের প্রভুরূপে স্বর্গে
মর্ত্যে করি বিচরণ, কীভাবে? নিজেরই জানা নেই।

মাঝে মধ্যে কাটাকুটিময় কিছু শব্দ-উঁকি-দেয়া
কাগজ বাইরে ফেলে দিই দূরে দারুণ হেলায়। মনে হয়, মনে হলে
তৃপ্তি পাই, সেসব কুড়িয়ে নেন অনন্তযৌবনা একজন অগোচরে-
সে রূপসী, সদাসঙ্গী যার অপরূপ বীণা আর সাদা হাঁস,
বাতিল কাগজগুলো ফুল-কুড়ানোর মতো করেন সঞ্চয়
আগামীকালের কোনও কবির ব্যাকুল অঞ্জলিতে তুলে দিতে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 127

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts