Poem

যাদের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয় তারা কেউই আর
ফিরে আসে না আমার কাছে। আমার বাবা, কোনও
কোনও ভাই, বোন, এক ছেলে-যারাই আমাকে ছেড়ে
গ্যাছে তারা কেউই ফিরে আসেনি। এই তো ক’মাস হলো
আম্মা গেলেন, তিনি প্রত্যাবর্তন করে মমতামগ্ন হাত
রাখেন নি আমার শাদা চুলময় মাথায়। আমি দেয়ালে
মাথা খুঁড়ে মরলেও তিনি আসবেন না আর। আমার কোনও
কোনও বন্ধু নিজেদেরই অপরাধে আমার কাছ থেকে দূরে
সরে গেছেন। তাদের সঙ্গে মামুলি কুশল বিনিময় তো দূরের
কথা, সুখদর্শনও নাস্তি। ওরা কেউ কেউ দুয়ো দেয়, কেউ
কেউ সাধে শক্রতা।

অথচ আমার বারান্দায় ভোরবেলা টাটকা মাখন-রোদ
গায়ে নিয়ে খেলতে আসে তিন-চারটি আদরণীয় অতিথি
চড়ুই। আমার ঘরে কখনও কখনও দুপুর কিংবা বিকেলে
ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। দোয়েল আমার হাঁটুর ওপর বসে,
কাঁধে ঠাঁই নেয় চঞ্চল প্রজাপতি। পায়ের কাছে পায়ের কাছে পায়রা-যুগল
সাবলীল প্রেম করে। বিরলদৃষ্ট যে কোকিল সে-ও সামনে
হাজির হয়ে প্রায়শ আমাকে অন্তরঙ্গ গান শুনিয়ে যায়। আর
আমার এই ছোট ঘরে মাঝে মাঝে দেখা দেয় এক মানবী
সত্তায় অনুপম বসন্তের বর্ণচ্ছটা নিয়ে। কথা এবং আচরণের
রোদ-জ্যোৎস্নাধারায় আমার খরাগ্রস্ত জীবনকে স্নিগ্ধ স্নান
করায়। আমরা দুজন গড়েছি এক প্রণম্য মনোজ বসতি। যদি
সে কোনও দিন আমাকে ছেড়ে ঠাঁই-নাড়া হয়, তাহলে দুনিয়া
আমার অ্যান্ধার, যেমন কবিতা আমাকে ত্যাগ করলে।


কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে জলবালিতে নয়, ইটখোলার ইটের
টুকরোটাকরা অথবা আমাদের এই গলির ধুলোকাঁকরেও
নয়, মাঝে মাঝে সকাল-দুপুর, গোধূলি-সন্ধ্যা কিংবা মধ্যরাতে
ঘরের মেঝে আর বিছানায় কোথাকার পাথরের নুড়ির ওপর
গড়াগড়ি দিই। আজকাল রাতে ঘুম প্রায়শই লাপাত্তা। জানি,
চিকিৎসাশাস্ত্রের বরাত দিয়ে লোকে ইনসমনিয়া বলে এই উপসর্গকে।
নির্ঘুম রাতে আমার কণ্ঠনালী দিয়ে জঠরে ঢুকে যায় বালিকণা,
বেবি ট্যাক্সি, ট্রাক-বাসের কালো ধোঁয়া, ইটের ভগ্নাংশ, মরা পাতা,
বাতিল বিয়ার ক্যানের খণ্ড, পুরনো টুথব্রাশ, কাঁকর, ছেঁড়া
চিঠি, বাৎস্যায়ন ঋষির ‘কামসূত্রে’র একটি মলিন পাতা, আর
পাথরের অনেকগুলো নুড়ি। কখনও কখনও কয়েক দিন পর,
আবার হয়ত সে-রাতেই আমার ভীষণ বিবমিষা হয় আর
আমি বমন করি পূর্বাষাঢ়া, রেবতী, বিশাখা, স্বাতী,
শতভিষা, জোহরা সিতারা, সপ্তর্ষি মণ্ডল আর কিছু অচেনা
মণিমুক্তো। সংবিং ফিরে এল আমি বিস্মিত-থরথর হাতে
সেগুলো কুড়াতে থাকি।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 99

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts