Poem

(বেগম সুফিয়া কামালকে নিবেদিত)

বিনীত শোভিত ঘর, সামান্যই আসবাবপত্র, কতিপয়
ফটোগ্রাফ দেয়ালে, টেবিলে,
দেয়ালে সর্বদা জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষ।
ঘরময় আনাগোনা,
কখনো ঘুমিয়ে থাকে এক কোণে শব্দহীন ট্রানজিস্টারের
মতো একা, আলস্যের স্তূপ।
ঘরের অত্যন্ত অভ্যন্তরে প্রায়শই মধ্যরাতে
কে যেন বাজায় এক করুণ বেহালা,
মধ্যরাত ঝরে তার হৃদয়ের নিঝুম চাতালে।

কোনো কোনো দিন
অতিথি আসেন কেউ কেউ,
দেশী কি বিদেশী; কেউ চুপচাপ চেয়ারে থাকেন ব’সে,দৃষ্টি
বুলোন চাদ্দিকে, যেন কোনো পুরাকীর্তি
দেখার উদ্দেশ্যে এসেছেন খুব দূর দেশ থেকে,
কেউবা করেন প্রশ্ন খুঁটিনাটি, কেউ কেউ তাঁর
সত্তায় সন্ধানী চোখ রেখে জেনে নিতে চান বুঝি
একটি যুগের সূর্যোদয়, অস্তরাগ।

জননীর হৃদয়ের মতো ঘর, প্লুত নিরালায়,
সেখানে থাকেন কবি। মেঝেতে লুটিয়ে-পড়া রোদ,
জানালার জ্যোৎস্না তিনি করেন সেলাই
খাতার পাতায়, অকস্মাৎ কেউ তার মুখ দেখে
চমকে উঠতে পারে-দীর্ঘ তপঃক্লেশে চক্ষুদ্বয়
ওষ্ঠ, নাক এবং চিবুক বুঝি এরকমই হয়। অন্তর্গত
দহন পায় না কেউ টের, দ্যাখে তিনি কী নির্মল

হাসেন, বলেন কথা আনন্দ ছড়িয়ে চতুষ্পার্শ্বে।
অবশ্য কাঁদেন কোনো কোনো রাতে অন্তরালে বিছানায় শুয়ে
ভীষণ একাকী।
তাঁর প্রতি আছে বনবাদাড় পাহাড় চিতাবাঘ আর তৃষিত হরিণ,
দিনের ত্র্যাভেন্যু আর রাত্রির কলোনি আর রজনীগন্ধার সমর্থন।
কখনো নিজের ঘরে নিজেই অতিথি, যেন এই
প্রথম এলেন, গল্পগুজবের শেষে
তাহলে বিদায় বলে বাগান পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে
নিঃশব্দে যাবেন চলে কে জানে কোথায়।
কখনো দ্যাখেন তিনি ঘরের দেয়ালে একজন
সুদূর কিশোরী ঘন ঘন পা দোলায় খাটে ব’সে,
কুয়োতলা নিমজ্জিত কুয়াশায়, সাঁঝবাতি গভীর ইশারা;
কখনোবা কারো স্মিত শরীরের প্রথম বানারসী জ্বলে, যেন
সূর্যোদয়; দ্যাখেন কোত্থেকে
সহসা একটি ঘোড়া ঢুকে পড়ে ঘরে তার মেঝেতে পা ঠুকে
ঠুকে খুব সহজেই জাগায় ঝরনার গান, বনস্থলী। নুড়ি
গড়াতে গড়াতে সুপ্রাচীন মুদ্রা হয়, মুদ্রা শিল্পীর আঙুল;
ক্ষেতের আইল জাগে ঘরে, জাগে চৌরাস্তা, মিছিল-
কবির সামান্য ঘর নিমেষেই সারা বাংলাদেশ হয়ে যায়!

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 135

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts