Poem

কবিতা, দ্বিরূপিণী

শামসুর রাহমান

কবিতাকে নিয়ে আমি বাস্তবিকই মুশকিলে পড়েছি।
দ’দণ্ড দেয় না শান্তি, কেবল অশান্ত করে রাখে।
স্নানাহার শেষে মাথাভরা পরিপাটি চুল নিয়ে
নিভৃত শয্যায় শুয়ে শুয়ে
বই পড়ি কিংবা ফুঁকি সিগারেট, হঠাৎ কোত্থেকে এসে বড়ো
এলোমেলো করে দ্যায় চুল
কোনো কোনো দিন।
মধ্যরাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, ঘরময় শুনি নিশিডাক,
বলা-কওয়া নেই
কখনও কলজেটাকে এমন নাড়িয়ে দ্যায়, হায়,
বেড়ে যায় বুকের স্পন্দন।
কবিতাকে নিয়ে আমি বাস্তবিকই মুশকিলে পড়েছি।

গ্রীষ্মের রাত্তিরে ঘুমহীন, প্রেমহীন জানালার কাছে যাই,
বাতাসের সাথে
আচমকা সে-ও ঢুকে পড়ে ঘরে। কখনও শরীর হয় জ্যোৎস্নাময় বন
কখনও-বা রৌদ্র উচ্ছসিত
উদাস প্রান্তর,
আদিম অরণ্যঘ্রাণ কখনও সত্তায় তোলে আলোড়ন। সে তো
বুকের ভিতরে দ্যায় ছেড়ে সোনালি রূপালি মাছ কতো,
আমাকে জাগিয়ে রাখে প্রহরে, প্রহরে ক্লান্ত করি নিশিদিন।
চোখে হানে জ্বালা,
মাথার ভিতরে জ্বলে দ্বীপের উৎসব, ফের চকিতে নেভায় এক ফুঁয়ে।

প্রত্যহ দু’দিক থেকে আসে দু’জন আলাদা নারী।
একজন, তার লক্ষ্মী লক্ষ্মী ধরন চিনতে
কখনও হয় না ভুল, বলে-
চলো যাই হ্রদের নিকারে বসি, রাখি
চোখ ঐ গোলাগের গোলাপি হিল্লোলে,
এসো, এসো প্রাচীন গুহায়
দেখাবো পরীর নাভিমূল,
তোমাকে দেখাবো রাজা আর ক্রীতদাসীর সঙ্গম;
একা হও তুমি,
তারার অলীক তলোয়ারে বিদ্ধ হও, বিদ্ধ হও।
অন্যজন ছিন্নমস্তা, লংকার ঝালের মতো ঝাঁঝ কণ্ঠস্বরে
মেখে বলে-
চলো যাই শ্মশানে অথবা গোরস্তানের বসি কিছুক্ষণ, দেখি
কঙ্কাল-মিছিল।
তুমিও আপনার শরীরে পেরেক ঠুকে দ্যাখো
যীশুর যন্ত্রণা
সইতে পারো কি না,
ক্রমাগত ক’দিন উপোস করে দ্যাখো অনাহার কায়ক্লেশ
কত যে সহনযোগ্য আর ক্ষুধার্ত শিশুর গালে গাল রেখে
জেনে নাও মুত্যৃর শৈশর।
মুমূর্ষ বৃদ্ধের কানে প্রজাপতি আবৃত্তি করলো
কোন পদাবলি
জানবে না তুমি? পদকর্তা মৃতের চোখের কোণে জেগে থেকে,
কাঁটার মুকুট পরে লেখো দ্বিধাহীন-
আমরা সবাই আজ দুর্ভিক্ষের বিকৃত সন্তান।
দু’জন দু’দিক থেকে টানে আমাকে নিয়ত, আমি
কখনও এদিকে
কখনও ওদিকে ঝাঁকে পড়ি,
যত বলি ছাড়ো পথ, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও হে
নারী, দ্বিরূপিণী,
ততই তাদের খেলা ভীষণ হিংসুক হয়ে ওঠে।
কখন যে দু’জন চকিতে একজন হয়ে যায়, বোঝা দায়-
একই আলোবৃত্তে
হ্লাদিনী নর্তকী নাচে, ফোটে নানা মুদ্রা ক্ষণে ক্ষণে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 100

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts