Poem

লক্ষ্মীবাজারের রৌদ্রময় অন্ধকারে

শামসুর রাহমান

আমার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অনেক পোড়া, আধপোড়া,
ছেঁড়াখোড়া, ছাই-হয়ে-যাওয়া বইপত্তর, খাতা, কলম,
ছিন্নভিন্ন জামাকাপড়, বিছানা, কয়েকটি স্পঞ্জের স্যান্ডেল
এক পাটি উল্টে-থাকা মেয়েলি জুতো। এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে
দাঁড়িয়ে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কোন্‌ শতাব্দী
এখন লালন করছে আমাকে! কোন্‌ শতাব্দীর আসুরিক ক্রূর
অন্ধকার এখানকার আলোকপ্রার্থী, প্রশান্ত, সুশীল বিদ্যানিকেতনে,
উপাসনা-স্নিগ্ধ গির্জায় জুড়েছিল প্রলয়-নাচ?

বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদে দাঁড়িয়ে দেখছি ধুলোয় লুণ্ঠিত হাত-পা
আর মস্তকবিহীন যীশু, বিচূর্ণ ক্রূশ; ভেতরে দগ্ধ, ধ্বস্ত ঘরে
ভীষণ আহত মাতা মেরী, আধপোড়া বাইবেল, তছনছ-করা, ক’টি
মুক বাদ্যযন্ত্র। যেন কোনও দম-আটকানো ঘোর দুঃস্বপ্নের ভেতর
আমার কানে এসে বারবার আছড়ে পড়ছিল শাহানা, পারভিন,
লতিফা, ক্রিস্টিনা, ললিতা, রাশেদা, ডেইজি গোমেজ, মল্লিকা,
আইরিন, সিলভিয়া ডি কস্টা, সুরাইয়া, রেহানা এবং আরও অনেক
শিক্ষার্থিনীর আর্ত চিৎকার।

না, মানুষ নয়, ধর্মান্ধতাপুষ্ট আয়েশলালিত অবিবেকী এক
চক্রচালিত কয়েক হাজার হিংস্র রোবটের তাণ্ডবে সৃষ্ট এই
ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি লজ্জায় নতমস্তক, বেদনাবিহ্বল।
চোখ তুলে দেখি অদূরে দাঁড়ানো ধূসর জোব্বা-পরা সক্রেটিস, প্লেটো,
অ্যারিস্টটল, চার্বাক, দান্তে, জালালুদ্দিন রুমি, ইবনে রুশদ, বার্ট্রাণ্ড
রাসেল, আইনস্টাইন, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন, ডিরোজিও
মাইকেল মধুসুদন, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, লালন ফকির, কাজী নজরুল
ইসলাম। প্রখর দুপুরে তাঁদের প্রত্যেকের মুখমণ্ডলে শ্রাবণের মেঘ,
চোখে তিরস্কার এবং ধিক্কারের স্তব্ধ বাণী। নিজেকে কেমন অসহায়, আক্রান্ত,
ক্ষতবিক্ষত মূর্তি বলে মনে হ’ল
সেইন্ট জেভিয়ার্স বিদ্যালয়ের রৌদ্রময় অন্ধকারে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 110

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts