Poem

মানুষ এসেই যায়

শামসুর রাহমান

বহুদিন ধরে যাচ্ছি,কখনো আনন্দে, কখনোবা কায়ক্লেশে
অত্যন্ত কাতর পথ হাঁটি। মাঝে-মধ্যে
পান্থনিবাসের প্রেতায়িত নিরালায়
থাকি মধ্যরাতে; মধ্যরাতে মগজের
ভেতরে বেড়াল হয়ে ঘুমোয় পেলব, নিরিবিলি।

বহুদিন ধরে যাচ্ছি, কখনো হঠাৎ কোনোখানে
যাত্রা থেকে গেলে দ্বিপ্রহরে
কিংবা গোধূলিতে
আশেপাশে কুয়োতলা, কল খুঁজে নিই, জলপান করে দীর্ঘ
স্মৃতির মতন পথরেখা
স্মৃতিতে মিশিয়ে, অন্য তৃষ্ণা নিয়ে, আবার নিঃসঙ্গ পথচারী

আমার ফেরার কথা ছিল নিশীথের মৃত্তিকায়
কামিনী ঝরার আগে। সেই কবে রজনীগন্ধাকে
কথা দিয়ে চলে গেছি কতদিন ভাবলেশহীন,
কাঁটার খতরা ছিল পদে পদে, অথচ আমার
সৌজন্যসম্মত ভঙ্গি খায়নি কখনো টোল; শুধু
প্রত্যাবর্তনের গান ভুলে
অচেনা পথের দিকে চোখ রাখি বারংবার, সামনে বাড়াই
পদযুগ; পদযুগ ধূলিময়, বীণাধ্বনি, স্বপ্নের মহলে
মখমলে ঢাকা। মমতায় প্লুত কোনো মৃত্তিকায়
শেকড় লাগে না; এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে
চলে যেতে হয় বলে চলে যাওয়া? অস্থায়ী ডেরায়
রাত্রিশেষে কাঠখড় ভস্মীভূত হ’লে, পাখিদের পাড়া খুব
নিঝুম বিবশ হ’লে শবব্যবচ্ছেদ মনে করে
আমি কি মুছি না চোখ? থাক,

শোকগাথা রচনায় কাজ নেই। রিক্ততার রুক্ষ তপোবনে
কেটে গেছে বহু বেলা, তপোক্লেস বেড়ে যায় ক্রমাগত; এবার সত্তার
সম্ভ্রম বাঁচিয়ে অন্ধকার
পথের আড়ালে পথ খুঁজে নেব, খুঁজব দিগন্তের অশ্বপাল।

আমার ফেলার কথা ছিল বনস্থলী থেকে খুব
কান্তিমান সাদা ঘোড়া বেরিয়ে আসার আগে; আমি
প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি রাখিনি বলে ওরা
সেই কবে থেকে ব’সে আছে পথপ্রান্তে, নদীতীরে।
মাঠে তাঁবু, কেউ কেউ অপেক্ষায় কাবু সন্ধ্যালোকে।
ওদের সবার জন্যে বীজ নিয়ে আসব বলেই
দিগন্তের দিকে মুখ রেখে ব’সে আছে বহুজন।
কেউ কেউ হাই তোলে, চুল টানে; ধনুকের ছিলার মতন
কেউ কেউ। মরমীয়াবাদী যেন কেউ কেউ, ওদের দু’চোখে
প্রতীক্ষার মতো কত প্রহর গড়িয়ে যায়, যায় নিত্য যায়।

‘সে আসবে’ বলে অনেকেই গল্পে মাতে, গেরস্থালি
ছিন্নমূল মানুষের গন্ধে ভরপুর। জ্যোৎস্না আর গীতধারা
একই স্রোতে মিশে যায়, কখনো দোলনা দুলে ওঠে
ঘুমপাড়ানিয়া গানে। আকাশ কবির
খাতার মতন সম্ভাবনাময়, কেউ দূর আকাশের দিকে
আঙুল দেখিয়ে বলে,-‘এই তো আমার কাঁথা, রুপোলি নকশায়
অর্থময়, আমি এর অনন্ত ঔদাস্য
সমর্থন করি। একজন বৃদ্ধ বলে,
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘যে গেছে সে প্রতারক,
আসবে না কস্মিনকালেও;
‘যদি সে কখনো আসে, আমার মাথায় মাবুদের
‘লানত আসবে নেমে, লিখে রাখো তোমরা সবাই।
একজন নারী তার চুলরাশি মেঘময় সন্ধ্যায় ছড়িয়ে
বলে মৃদুস্বরে, ‘যে গেছে সে বিশ্বাসঘাতক
‘হৃদয়ে পাথর তার, চক্ষুদ্বয় দাগাপ্রিয় খুব,
‘আসবে না, আমি চুল ছিঁড়ে নদীতীরে উন্মাদিনী হয়ে ছুটে
‘বেড়ালেও আসবে না খল, প্রবঞ্চক।

আমার ফেরার কথা ছিল পাখির চোখের মতো
লোকশ্রুত নৌকো ঘাটে লাগার আগেই।
ওদের ক্ষেতের জন্যে বীজ অত্যন্ত স্বপ্নিল হয়ে
প্রগাঢ় রয়েছে জমা আমার মুঠোয়, যতদিন যায় বীজ তত স্বপ্ন হয়।

সর্বদা জমিন ডাকে, বীজ কী প্রবল ছুটে যেতে চায় শূন্য
মৃত্তিকার প্রতি
আমার মুঠোর খোসা ছিঁড়ে। বীজ নিয়ে এসে দেখি
আমার আপন প্রত্যাবর্তনের পথে, রাত্তিরেই ফেরা, কোনো
মশালের চিহ্ন নেই, বাদ্যরব নেই, নেই নারীর বিস্ময়।
জমিনে ছিটিয়ে বীজ আমি স্বপ্ন হই, বীজ স্বপ্ন, স্বপ্ন সোঁদা
ধান গন্ধময়, বীজ মরালের ওড়াউড়ি, নিদ্রায় কাতর
ওদের ঘুমন্ত ওষ্ঠে, গালে বীজ চুমো খায়। প্রত্যাবর্তনের
পথে আমি দেখি এক কবির কঙ্কাল বর্ষাভেজা
হাওয়ায় দোদুল্যমান যূথিবনে, তার অক্ষিগর্ত যেন গায় গান-
মানুষ এসেই যায় শেষে নিরুদ্দেশ থেকে মানুষের আপন নিবাসে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 171

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts