Poem

মহাপৃথিবীর রাগমালা

শামসুর রাহমান

প্যারিসের জনস্রোত, যানস্রোত, ইতিহাস-দীপ্ত হর্ম্যমালা,
পথঘাট, মিউজিয়ামের ঘটা, বোবস্‌পীয়ার,
বোদলেয়ার ও জাঁ-পল সার্ত্রের নানা স্মৃতি-উন্মুখর
রেস্তোরাঁ, শেনের জলধারা থেকে দূরে সিমুরের
সবুজের অকৃপণ স্নেহস্পর্শে প্রকৃতি আপন অন্তর্বাস
অসঙ্কোচে উন্মোচন করে।

লোকটা এখানে ছিল কোনওদিন, ছিল
প্রকৃতির খুব কাছে, ঈষৎ আলাদা
পাথরের মাঝে ছিল দিনরাত, কেটে গেছে তার
জীবনের বেশ কিছু দিন ছেনি আর হাতুড়ির
তন্ময় আঘাত হেনে পাথরের বুকে খুঁজে নিতে সুন্দরের
নানা মূর্তি। গুহাবাসী মন গড়ে তোলে
পাথরেই নান্দনিক ভিন্ন রূপ মানসের আর কী বিপুল
সৃষ্টির আনন্দে মেতে থাকে নিত্য বেপরোয়া মাতালের মতো।

লোকটা দেখতে ছিল টাইটান, সুপ্রচুর খাদ্য আর
অঢেল মদিরা রোজ হতো জঠরস্থ
অথচ সচল ছিল প্রায় হামেশাই
হাতুড়ি ও ছেনি, চার বছরের প্রতি দিনরাত্রি একাকার
লোকটার। একটানা এভাবেই কেটে যায়
কয়েকটি আশ্চর্য বছর। অবশেষে একদিন অবেলায়
শিল্প নেয় বলি, টাইটানের প্রদীপ্ত দু’টি চোখ অতি শ্রমে
বুজে আসে, থেকে যায় বুকের স্পন্দন। আর সেই
বুভুক্ষু পাহাড়ি গুহা থেকে থেকে করে উচ্চারণ,
‘শিল্প তো আদায় করে কড়ায় গণ্ডায় তার সকল পাওনা’।
সে গুহায় এখন প্রত্যহ অনেকেই যায়, কখনও কখনও
শিল্পতীর্থ ভিড় জমে খুব; কেউ কেউ বাঁকা ধোঁয়া-ওঠা
চায়ের পেয়ালা কিংবা মদিরার গ্লাস হাতে সেই
গতায়ু শিল্পীর কথা বলাবলি করে, কেউ কেউ
নোট নেয় খবরের কাগজের অতৃপ্ত উদর
ভরাট করার জন্য। শিল্পীর বিধবা পত্নী কারও কারও হাতে
কটি গুহাচিত্র গুঁজে দেন
তাজা ব্যাঙ্কনোটের সহজ বিনিময়ে। দূরে পাখি কেঁদে যায়;
গুহাস্থিত পাথরের বুক চিরে কিছু
অনন্য ভাস্কর্য ক্ষণে ক্ষণে গায় মহাপৃথিবীর রাগমালা।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 107

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts