Poem

নির্জনতার জন্যে প্রার্থনা

শামসুর রাহমান

আমাদের দুজনের চারপাশে সুদূর
মেঘের মতো নির্জনতা থাক,
এই মতো চেয়েছি কতদিন।
একটি কি দুটি পাখি অথবা প্রজাপতি
সেই নির্জতায়
দোল খেতে পারে সহজে, হাওয়া অন্ধকার
এবং জ্যোৎস্নার প্রবেশাধিকার থাকবে;
আমাদের দুজনের কথা বলা আর
না-বলার মাঝখানে গান গেয়ে
উঠতে পারে কোনো কোমল বুকের পাখি, ক্ষতি নেই।

কাঙ্ঘিত সেই নির্জনতা প্রত্যহ
লুকোচুরি খেলে আমার সঙ্গে। কী এমন
ক্ষতি হতো কার, যদি আমরা,
তুমি আর আমি, দু’দণ্ড
নিরিবিলি বসতে পারতাম কোনো
বকুলতলায় সময়ের নির্জন ঘাটে?

আমরা দুজন বসে থাকি নিশ্চুপ,
আমাদের নীরবতার চোখ ঘষে দ্যায়
দুটি কি তিনটি শাড়ি, একটি কি দুটি
সাফারি স্যুট। অনর্গল কলরব আমাদের
দুজনের সাহচর্যকে ঠোকরাতে থাকে
উন্মত্ত বাজপাখির মতো।

প্রতিদিনের এই কলরবে
তোমাকে নিজের মতো ক’রে পাওয়ার আমার ব্যাকুলতা
তোমার কোলে মাথা রেখে
বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে তৃষিত। এই ভিড়ে
আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না।
কিন্তু আমার অস্তিত্বের
পরাগগুলো তোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে
শুভেচ্ছা ঝরায়। আমার স্বপ্নগুলো তোমার
মুখ চুম্বন করে, আমার অকথিত নিরাশ্রয় শব্দমালা
সোনালি ত্রাণশিবির তোমার হৃদয়ের তন্তুজালে।

আমরা দুজন ঘন্টার পর ঘন্টা ব’সে থাকি
ড্রইংরুমে অথবা
খোলা বারান্দায়। বিভিন্ন কণ্ঠস্বর কোলাহল করে
জ্যাজের ধরনে।আমি প্রায়
কিছুই বলি না, বলতে গেলেও হোঁচট খাই,
আমার দুচোখ গড়িয়ে যায় সবার উপর।

সমবায়ী কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রত্যেকে
তুলে নেয় স্ন্যাক্‌স আর চায়ের পেয়ালা।
তুমি আমার দিকে এগিয়ে দাও স্যান্ডুইচ
এবং যখন তুমি আমার চোখে
চোখ রাখো সপ্রেম,
আমার অনুভূতিমালা প্রবল কেঁপে ওঠে,
যেন ঝোড়ো ঢেউয়ে ফুলদল;
কিছুতে চোখ ফেরাতে পারি না।

রাত বাড়তে থাকে দ্রুত, অতিথিদের অবস্থান
যখন ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন করতে উদ্যত,
তখন শুরু হয় বিদায়ের পালা। আমি
গুলিবদ্ধ পাখির মতো অভিমান লুকিয়ে
সৌজন্যের মোড়কে বেরিয়ে আমি ড্রইংরুম থেকে
অন্ধকারে পা বাড়াবার সময় দেখি,
তুমি দাঁড়িয়ে আছো দরজায়, সৌন্দর্যের আভাময়ী। তোমার
অভিমান আমার অভিমানের সঙ্গে মিলিত হ’য়ে
একটি মায়াবী পাখি হ’য়ে নিঝুম যাত্রা করে
দূরের ছায়াপথ আর নক্ষত্র-নীড়ে।

এবং সেই উধাও পাখি
নির্জনতার জন্যে প্রার্থনারূপে অবিরাম
চক্রাকারে ঘুরতে থাকে
আমাদের দুজনের তৃষিত মর্মমূলে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 118

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts