Poem

নিশ্চিত বলা যাবে না কিছু

শামসুর রাহমান

ঘরে বসে আছি একা। অকস্মাৎ এক ঝাঁক হল্‌দে প্রজাপতি
ঢুকে পড়ে পাখনা দুলিয়ে, প্রজাপতিদের চোখ
এই নম্র হলুদ বিকেলে
চকিতে আমাকে দেখে কী ভাবে? কে আমি
ওদের নিকট? দেয়ালের টিকটিক, কাচপোকা
এবং নিজের তৈরি নক্‌শি-জালে ধ্যানমগ্ন মাকড়সা-ওরা
আমার বিষয়ে কিছু জানে কি বস্তুত?
ওদের বাস্তবতায় আমার কি আছে বাস্তুভিটা এক কোণে?

০২
কী এক রহস্যময়তায় শহরলীর ছায়াচ্ছন্ন ছাদে
ভাষা থেকে সরে
জীবনানন্দের কিছু স্বপ্ন মেঘমালা হয়ে ভাসে।
সেসব মেঘের রোঁয়া অভিমানে কোন্‌ সে সুদূর
বঙ্গাব্দে নীরবে পৌঁছে যাবে,
গড়বে উৎসব এক তারাময় সমারোহে আকাশে আকাশে।
জীবনানন্দের ভাষা ঘাস আর শিশিরের সংসর্গে এবং

হ্যাইড্রান্ট আর নুলো ভিখিরির ছেঁড়া ন্যাকড়ার কটু গন্ধে
ভরপুর অপরূপ ওড়াবে নিশান সৌরলোকে। অরুণিকা
সান্যালের মুখে জেগে থাকবে কুয়াশায় কিংবা জ্যোৎস্নাময়তায়।

০৩
নিশ্চিত বলা যাবে না পঙ্‌ক্তিটি কোথায়
গায়েব হলো। কিছুক্ষণ পর অনূঢ়ার হাসির মতো রোদ
ছড়িয়ে পড়ে। পাশের বাড়ির তরুণী বারান্দায় এসে দাঁড়ায়;
একটা কাক বাতিল হাঁড়িতে জমে-থাকা পানি
শুষে নিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। কিয়দ্দূরে মলিন খুপরিতে বসে
একজন তরুণ কবি খাঁ খাঁ শূন্যতার ভেতর থেকে
টেনে তোলে জালে ধরা-পড়া চকচকে মাছের মতো
কয়েকটি চিত্রকল্প আর গাছের পাতাগুলো
করতালি বাজিয়ে সবুজ পরীর হাতে রূপান্তরিত। পঞ্চাশ
বছরের মালতীকে ওরা কি খুন করেছিল এমন ঝকঝকে
ভেজা দুপুরে?

০৪
বলব কি রাত্রির টহলদার পুলিশের বুটের আঘাতে
কাতরাচ্ছে লাজুক আঁধার?
বলব কি ‘সাতটি তারার তিমির’কে
সাতটি অমল হাঁস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে
কর্মিষ্ঠ ডানায়? বলব কি
মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বড় একা শুয়ে আছি নক্ষত্রের খাটে;
হাতে কির্কেগার্ডের কেতাব? বলব কি অ্যাম্বলেন্সে অচেতন
যাচ্ছেন মুমূর্ষ ছুটে যিনি, সুজন সে-নাগরিক
আমারই সুহৃদ? বলব কি দিচ্ছেন আমার দিকে
এগিয়ে সুরার পাত্র মাইকেল মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দে মেতে?
বলব কি আমার পায়ের জুতোজোড়া খুব ছোট হয়ে গেছে বলে
আঙুল ভীষণ ফেটে রক্ত
ঝরছে কেবল? বলব কি আমার পায়ের নিচে
সুশীতল ঝর্ণাধারা বয়?
বলব কি আমার কলম
মেরুপ্রদেশের তুষারের ঝড়ে সমাহিত হবে একদিন?

০৫
এই তো খুড়িয়ে-হাঁটা হরিণের আহত পায়ের
ক্ষতে পট্রি বেঁধে পোস্টমর্ডাণ কবির
চোখে মুখে লান্তি নামে; তিনি ঝিলের কিনারে ঝরা
পাতার বালিশে মাথা রেখে
ঘুমিয়ে পড়েন, স্বপ্নে মঙ্গলকাব্যের পাঁচালির খুঁটিনাটি জড়ো হয়।
দেহাতি চাঁদের দিকে তাকাতে তাকাতে
গাজনে মজেন কবি আর বঙ্গাব্দের পর বঙ্গাব্দ পেরিয়ে
যান বসে ময়ূরপঙ্ক্ষীর পাটাতনে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 113

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts