Poem

নক্ষত্রের মানব কলোনি

শামসুর রাহমান

পা হড়কে পড়তে পড়তে কোনওমতে নিজেকে
সামলে নিই এই গা-ছমছমে অমাবস্যা-রাতে। মনে
হলো, কে যেন পিছন থেকে
আচনকা ধাক্কা দিলো, অথচ
পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না। সারা
শরীরে ছমছমে অনুভূতি; এ কোথায় চলেছি?

ইচ্ছে হলো, গলা ছেড়ে কাউকে ডাকি, ভীতি
এবং উৎকণ্ঠা গলায় যেন
মুঠো মুঠো শুষ্ক বালি গুঁজে দিলো। এক হাত
দূর থেকে অতিশয় কর্কশ কোনও কণ্ঠস্বর আমাকে
বেয়াড়া চড় বসিয়ে দেয়, ‘কে রে তুই আমাদের এলাকায়
বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছিস? এখুনি দূর হ।

মাছি-মারা কেরানির মতো খুব ভড়কে গিয়ে
লেজ গুটিয়ে তক্ষুনি দিক পরিবর্তন করি। হাঁটতে হাঁটতে
মাথার ঘাম পায়ে লুটিয়ে পৌঁছে যাই
এক হ্রদের কিনারে। নজর কাড়ে হ্রদেরর জলে পা ডুবিয়ে
বসে-থাকা, সব ভুলিয়ে-দেয়া হৃদয় হরণকারী
এক রূপসী, যার সত্তায় অপ্রতিরোধ্য আহ্বান।
আমার বয়সের ধূসরিমা বিস্মৃত হয়ে এগিয়ে যাই
ওর দিকে সম্মোহিত পথিকের ধরনে। আচমকা
বিকট এক আওয়াজ ওকে মুছে ফেলে সেই
দৃশ্য থেকে, যেমন রাগী চিত্রকর ক্যানভাস থেকে নিশ্চিহ্ন
করে তার সৃষ্টি। আশাহত, বিব্রত আমি
হাহাকার হ’য়ে ঘুরতে থাকি সরোবরের চারদিকে। নিমেষে
এক ধরনের উন্মত্ততা আমাকে
দখল ক’রে নেয়। আমি খোরাক হবো হিংস্র বিরানার?

অকস্মাৎ মধ্যরাতে দূর থেকে ভেসে-আসা
বস্তি উজাড়ের বুক-কাঁপানো আর্তনাদ আমাকে
ছিনিয়ে আনে ছেঁড়াখোঁড়া ঘুম থেকে। কেমন
অবাস্তব মনে হয় ঘরের চেয়ার, টেবিল, বুক শেল্‌ফ, দেয়ালে
সাজানো রবীন্দ্রনাথের ছবি; নিজের অস্তিত্ব প্রতিভাত
পদচারী ছায়ারূপে। হ্রস্ব এক মোমবাতি টেবিলে
গলে গলে পড়ছে। নানা ধরনের ছায়ার কণ্ঠে করুণ কোরাস।

কখনও কখনও ইচ্ছে হয়, ঘরপোড়া দুঃখীদের
বসবাসের জন্যে আকাশ থেকে
ছিঁড়ে আনি অগণিত জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, একটি
বাড়ি নির্মাণ করি নক্ষত্রমালা দিয়ে, নাম রাখি ‘মানব কলোনি’।
যদি ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে আনি আকাশের পুষ্পরাজি,
আসমান করবে না প্রতিবাদ, সুনিশ্চিত জানি।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 96

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts