Poem

অমাবস্যাময়ী এক নারী

শামসুর রাহমান

এখন বয়সের সেই সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছি,
যেখানে উষ্ণতার চেয়ে শৈত্যপ্রবাহ
প্রবল, যেখানে শরীরে যখন তখন আতশবাজি
ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত নয়, যদিও
সময়ের তিমিরাচ্ছন্ন গলিতে মুখ থুবড়ে পড়ার পরেও
প্রায়শ হৃদয় শবেবরাতের মোমবাতির উৎসব।

এখন আমি সেই নারীকে কামনা করি প্রতিক্ষণ,
যার যৌবন শারদ মধ্যাহ্ন থেকে হেমন্ত-গোধূলিতে
ঝুঁকে পড়তে কলেজের ছাত্রীর মতো উন্মুখ।
আমার কত সকাল আর দুপুর
স্পন্দিত তার কথার ষড়জে নিখাদে, কত সন্ধ্যা
হয়েছে দীপান্বিতা তার উপস্থিতিতে। তার কথাগুলো
আমি সতত পান করি, যেমন তৃষ্ণার্ত হরিণ
গোধূলির রঙ-লাগা ঝিলের জল।

মাঝে মধ্যে কে আমাকে নিক্ষেপ করে সিয়াহ গহ্বরে,
যেখানে মানুষ আর পশুর হাড়গোড়
বেকুর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে বিকৃত অন্ধত্বে? কে আমার
ওপর বিছিয়ে দেয় নিষ্ঠুর অনুপস্থিতির
ধূসর চাদর? কে আমাকে লকলকে শীতল জিহ্বায়
চাটতে থাকে প্রহরের পর প্রহর? কী করে সেই
গহ্বর থেকে পরিত্রাণ পাবো ভেবে পাই না। আমার
চৌদিকে ঝুলে থাকে নীরবতার মৌমাছি পুঞ্জ।
যার টলটলে অনন্তের ছোঁয়া-লাগা চোখ,
কখনো আনন্দে, কখনো বা বিষাদে
আল্পুত যার সৌন্দর্য, মাঝে-মধ্যে তার তার সঙ্গে দিনের পর দিন
দেখা-না হওয়ার করাত
আমাকে টুকরো টুকরো করে, আমার হৃৎপিণ্ডের
রক্তক্ষরণে অশ্রুপাত করে দোয়েল আর নক্ষত্রেরা।
কোত্থেকে অমাবস্যাময়ী এক নারী
তীক্ষ্ণ উলঙ্গতাকে নাচিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে;
ওর হিংস্র দু’টি বেড়াল-চোখ
আর দীর্ঘ ধারালো দশটি নোখ আমার
শরীর আঁচড়াতে থাকে। অসহ্য ব্যথায়
কাতরাতে কাতরাতে বলি, ‘কে তুমি?’ অন্ধকারকে
অধিক তমসাবৃত করে সে বলে, ‘আমাকে বেশ
ভালোই চেনার কথা তোমার। যারা জানে
ভালোবাসা কারে কয় তারা আমার
নাম রেখেছে বিরহ।

এই রমণীর কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে
সেই উল্লসিত সোনালি
নারীর উদ্দেশে হাত বাড়াই, যাকে
মিলন বলে শনাক্ত করতে শিখেছি কী স্বপ্নে, কী জাগরণে।
এখন তার না-থাকার কালো, লোনা পানির ঝাপ্টা
ঢুকে পড়ছে আমার হৃদয়ের ক্ষতে।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 140

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts