Poem

অপাঙ্‌ক্তেয়

শামসুর রাহমান

যেহেতু লৌকিকতার দড়িদড়া ছিঁড়ে বেপরোয়া
উঁচিয়ে মাস্তুল সুন্দরের ভাস্বর সে নীলিমায়
ভ্রমণবিলাসী তাই সম্মিলিত মুখর প্রস্তাবে
দিয়েছ উন্মাদ আখ্যা, উপরন্তু চিরশক্র ভেবে
আমাকে করেছ বন্দি সন্দেহের অন্ধ ঊর্ণাজালে।

অথচ নারীর গর্ভে তমসায় নক্ষত্র-খচিত
আয়ুর অবোধ স্বপ্নে জন্মেছি আমিও, দন্তহীন
বাসনায় নিয়েছি অধীর মুখে স্তনাগ্র কোমল,
আর জুয়াড়ির মতো আপনাকে করেছি উজাড়
তীব্রতায় ধাতুর উজ্জ্বল মদে, ধুতুরার ঘ্রাণে।

মিথ্যাকে কখনো ভুলে সুন্দর ফুলের রমণীয়
স্তবকের মতো আমি পারিনি সাজাতে বঞ্চনায়,
বরং করিনি দ্বিধা কণ্ঠে তুলে নিতে আজীবন
সত্যের গরল। ফলত সে উন্নদ্র তৃতীয় চোখ
অন্ধের বিমূঢ় রাজ্যে বাদ সাধে বলে ক্রোধ জ্বলে
বারবার আত্মতৃপ্ত এই অন্ধ কূপের গভীরে।
নেকড়ের মতো সব মানুষের দঙ্গল এড়িয়ে,
মাংসের মূঢ়তা ছেড়ে নৈঃসঙ্গে সম্পন্ন হয়ে চলি;
উত্তপ্ত তোমার মতো শরীরের পৌত্তলিক যেন
অর্পিত, গ্রথিত প্রাণ ভীষণের আগ্নেয় মালায়।

জীবনকে সহজ নিয়মে নেয়া যেত প্রথামতো,
কিন্তু তবু জ্যামিতির নেপথ্যে মায়াবী গুঞ্জরণে
মজেছি স্বতই দুঃখে অর্থ থেকে অর্থহীনতায়।
কুৎসার ধারিনি ধার, বরং নিজেরই আচরণে
বিপন্ন হয়েও শুধু সারাক্ষণ অস্তিত্বের ধার

রেখেছি প্রখর তীক্ষ্ণ আর ব্যালে নর্তকের মতো
চেয়েছি গতির ধ্যানে অনন্তের একটি মাধবী
উন্মোচিত আবর্তিত হৃদয়ের হলুদ আকাশে।
অথচ নিশ্চিত জানি জীবনের সুকান্ত আপেল
অলক্ষিতে রক্তিম চাঁদের মতো ঝরে সুনিপুণ

কীটের সুখাদ্য হবে যথারীতি। মাঝে-মাঝে তবু
নিজের ঘরের ছিদ্রে চোখ রেখে দেখি পৃথিবীকে,
যেমন বিকারী দেখে যুগলের মদির নগ্নতা,
কামকলা, অবসাদ, নিদ্রায় মধুর শিউরনো।
তোমরা সজ্জন সহৃদয়, বলি হৃদয়ের স্বরে

আমাকে গ্রহণ করো তোমাদের নিকানো উঠোনে
নারীর আর শিশুর ছায়ায় আঁকা, রক্তকরবীতে।
আমার জীবনে নেই তৃপ্তির গৌরব, আর আমি
অর্থ খুঁজি চক্রে চক্রে, সমর্পিত মহাশূন্যতায়।

কী অর্থ নিহিত তবে নিপতিত গাছের পাতায়?

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 253

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts