Poem

শব্দের সংস্রবে কতকাল

শামসুর রাহমান

শব্দের সংস্রবে কতকাল কেটে গেছে, মেলামেশা
ভালোবাসাবাসি
হয়েছে শব্দের সঙ্গে বারে বারে। দূর থেকে ওরা কেউ কেউ
বহুক্ষণ আড়চোখে তাকিয়ে থেকেছে, কতদিন কানামাছি
খেলার প্রস্তাব রেখে দিয়েছে সম্পট অকস্মাৎ
আমাকে কিছু না বলে। ধুলো কিংবা মেঘের আড়ালে
দূর দিগন্তের দিকে পলায়নপর
কাউকে কাউকে আমি উপড়ে এনেছি, বলা যায়,
মায়াবী উদ্যান থেকে। কেউ কেউ এমনই নাছোড়,
মধ্যপথে তর্ক জোড়ে, কে কোন পরিধি ভালোবাসে
বিশদ বুঝিয়ে দ্যায় যুক্তি বিশ্লেষণে। আজকাল, হা কপাল,
কোকিলও উকিল হয়ে যায়।
বাঁচাই ভাষার ঝরণাধারা। শত নুড়ি, লতাগুল্ম-রঙধনু,
কখনো বা খরবেগ চোরা টান থাকে, মাধুর্যের উন্মীলন,
বাঘের হুংকার,
নবজাতকের স্পন্দমান বুক অথবা লাশের পাশে প্রহর যাপন,
পুরোনো বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পাওয়া,
মর্চেপড়া চাঁদ,
স্বাস্থ্যেজ্জ্বল শবাগার থাকে ভাষার চঞ্চল ওষ্ঠে।
শব্দের ওপারে গোরখোদক পরখ করে মাটি সন্ধ্যেবেলা,
কুকুর প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে জ্বলজ্বেল চোখে,
একাকী কর্কশ খুনী হাত ধোয় ঝরণাতলে, জননী কন্যায় চুল বাঁধে,
বালক ওড়ায় দ্বিপ্রহরে কত সাবানের রঙিন বুদ্ধুদ,
পড়ার টেবিলে কেউ এলোকেশী মাথা রেখে স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে
শাদা ঘোড়া ছুটে যায় অভ্রের প্রান্তরে,
পায়ে তার সোনার মুকুট,
জলোচ্ছ্বাস,প্রেমিকের মুঠো থেকে প্রেমিকার হাত ছিঁড়ে যায়।
ভোরে অপরাহ্নে, চন্দ্রালোকে
স্মিত ডানা-অলা ডাকপিয়ন দোলনচাঁপা চিঠি তাড়া তাড়া
রেখে আসে লাল বাক্সে, উড়ে উড়ে ফেরে মেঘলোকে,
ভীষণ শুকিয়ে-যাওয়া ইঁদারার মতো কিছু মাঝে মধ্যে হাহাকার করে
আমার ভেতরে।

যদি উচ্চারিত হলে সর্বদা আমার দৃষ্টিপথে
একটি খয়েরী বাড়ি উদ্ভাসিত হয়, গেটে যার যুগল রূপালি ছুরি
ঝোলে সারাক্ষণ।
যখন অথবা বলে কেউ, একটি সুদীর্ঘ পথ, আজোজ্বলা,
মনে পড়ে যায়।
কাগজে আনলে তুলে অন্যমনে ভ্রমণ নামক শব্দটিকে,
আরক্ত কোমল গালে ঝুলে-থাকা কালো চুল, ভেজা চোখ, পুরনো পুকুর,
অশ্চিমে সূর্যের হারাকিরি,
ফসলবিহীন মাঠ ঘেঁষে রেল লাইনের ধারে বহুদূরে
পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, রাজসিক গাছের গুঁড়িয়ে বসে থাকা,
খঞ্জের মোহন যানে চেপে কয়েক মাইল সাবলীল চলে যাওয়া,
হঠাৎ পাখির সম্ভাষণ, মাধুর্যের স্পর্শ-লাগা,
স্মৃতিতে চাঞ্চল্য আনে।
অধিকন্তু মানে রৌদ্রঝলসিত বাবুই পাখির বাসা,
সূর্যের ভেতর পিকাসোর হাত, মেঘদল নেরুদার সঙ্গীতমুখর
পাণ্ডুলিপি, আদিগন্ত চাইকোভস্কির হংসমালা,
পাথুরে বেঞ্চিতে
সেজানের জাগরণ, জ্যোৎস্নালোকে ধাবমান বুনো অশ্বপাল।
হায় মধ্যরাতে ঘুমহীন মুহূর্তের ঝরে-পড়া, বুক-চেরা দীর্ঘশ্বাস,
এমন একটি ঘর যেখানে জ্বলে না আলো অনেক বছর,
তাকে ছেড়ে এসে পুনরায় বড় একা ঘরহীন ঘরে ফেরা।v

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 100

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts