Poem

শহুরে সংলাপ

শামসুর রাহমান

ঘন বৃষ্টি-আঁচড়ানো দুপুরে তোমার খুব কাছে
ছিলাম নিভৃত ঘরে। সে মুহূর্তে তুমি সাবলীল
প্রফুল্ল প্রতিমা। দেখলাম-
তোমার শরীরে ধানী রঙের তরঙ্গ যাচ্ছে ব’য়ে।
হঠাৎ বল্লাম, ‘চলো এই বন্ধ ঘরে ছেড়ে দূরে
কোথাও বেরিয়ে পড়ি রিক্‌শায় দুজন।
পুরানো ঢাকায় যাবে? সেখানে আমার
বালক বয়স আর কিশোর বয়স আর যুবা বয়সের
বহুদিন প্রীত উড়ে গিয়ে তোমার শাড়ির
আঁচলের মতো
ছুঁয়েছে নীলিমা অগোচরে। প্রিয়তমা,
চলো না সেখানে যাই সেই সরু গলির ভেতর,
যেখানে একদা আমি বন থেকে অনায়াসে
চিত্রল হরিণ ডেকে আনতাম, মেঘ ডেকে আনতাম ঘরে
নিরালা সংকেতে। দেখতাম বাতিঅলা
আসতো নিঃশব্দে হেঁটে গলির গলায়
পরাতে আলোর মালা, ভিস্তি মশকের ভারে নুয়ে
বিলোতো শীতল জলধারা ঘরে ঘরে। শুনতাম
কান পেতে তারা মসজিদ থেকে ভেসে-আসা ফজরের সুরেলা আজান
আর সন্ধেবেলা মন্দিরের মনকাড়া ঘন্টাধ্বনি।

সত্যি কি আমাকে নিয়ে যাবে আজ পুরনো শহরে,
যেখানে তোমার মন পড়ে থাকে আজো? জানি আজো
স্মৃতিকাতরতা
তোমার দুচোখে ফ্যালে ছায়া, তুমি কোনো কোনো ভোরে
স্বপ্নে জীর্ণ আস্তাবল, বেতো ঘোড়াদের ঘ্রাণ নিয়ে
জেগে ওঠো বিছানায়, ভাবো কবেকার চাখানাকে
সোলেমান বাদশার ধনাগার, কখনো আনন্দে ঝলোমলো
আমাকে শোনাও লালবাগ কেল্লার ভেতরকার
কবরে শায়িতা পরী বিবির কাহিনী। একদিন
বললে তুমি, ‘এই তো সেদিন
অনেক বছর পরে আমাদের প্রাক্তন বাড়ির কাছে গিয়ে
চিনতে পারিনি তাকে, যার পরতে পরতে ছিল
একদা আমার দিনগুলি, রাতগুলি। প্রতি ইটে লেখা ছিল
আমার কৈশোর, যৌবনের গজলের প্রেমাক্ষর।

-চলো যাই গোধূলিতে হাঁটতে হাঁটতে পুনরায়
বুড়িগঙ্গা নদীটির রূপ দেখে আসি একবার। সঙ্গোপনে
আমরা দুজন ঘাটে-ভেড়া বজরার ছাদে ব’সে পাশাপাশি
দেখবো সূর্যাস্ত, খাবো চিনেবাদাম অথবা
ঝালমুড়ি, অন্ধকার গাঢ় হলে মুখচুম্বন করবো
তোমার আবেগভরে, তারপর নেমে এসে বাকল্যান্ডে চোখ
রেখে হেঁটে যাবো পরস্পর হাত ধ’রে কিছুদূর। দেখে নেবো
পুরনো এ শহর কীভাবে
ঈষৎ বদলে যাচ্ছে নতুন যুগের আলিঙ্গনে,
যেমন আমিও সদ্য যুবা হই তোমার নিবিড় বাহুপাশে।
দ্যাখো এই মনোহারী দোকানের জায়গায় একদা
ছিল এক বটগাছ, লুপ্ত সেই বৃক্ষটির ছায়া
এখনো আমার মনে ছড়াম সুস্নিগ্ধ ছায়া তার। এই অতি-পুরাতন
মাটিতেই রোদে জ্বলে, জলে ভেজে আমার শিকড়।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 116

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts