Poem

শতাব্দীর বিদীর্ণ হৃদয় থেকে

শামসুর রাহমান

প্রত্যেকের কাছ থেকে আপনার সুখের অভাব
লুকিয়ে রাখাই চিরদিন
আমার স্বভাব।

কখনো চলতি পথে যখন জিজ্ঞেস করে কেউ
ভাবলেশহীন
বাড়িয়ে গেরস্ত হাত, ‘কেমন কাটছে দিন ইদানীং’, বলে-
ভালো, বেশ ভালো, পুনরায় পথ চলি
নিপুণ গোপন রেখে আমার প্রকৃত মনোভাব।

একদা স্বপ্নিল করিডরে যার শরীরের চন্দ্রোদয় দেখে
ছিলাম আচ্ছন্ন সারাক্ষণ তাকে ঝিল, ঝাউগাছ,
অথবা সোনালি মাছ
প্রাচীন হ্রদের কিংবা পাখি রূপে হৃদয়ের অভ্যন্তরে রেখে
বস্তুত সংসারকানা আজও আমি। আগে
অথবা অনেক পরে-কখনো সময় খুব করে প্রতারণা-
স্মৃতিকে গোধূলি শেষে বনভোজনের পোড়া কাঠ, বাসি খাদ্যকণা
ভেবে আপাতত এই অদ্ভুত শহরে করি বসবাস
কখনো বিরাগে, কখনো-বা অনুরাগে।

জানালার কাছে এসে শুনি ফুটপাত, গাছপালা,
পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ মার্কেটের বাণিজ্যিক
পথ ল্যাম্পপোস্ট যেন স্বপ্নভঙ্গজনিত বিষাদে
ফেলে দীর্ঘশ্বাস।
যন্ত্রণা আমার অস্তিত্বের রুক্ষ বিদীর্ণ ভূ-ভাগে
নিয়ত প্রগাঢ় লেখে তার হিজিবিজি বর্ণমালা।
সহসা কখন কী-যে হারিয়ে ব্যাকুল দিগ্ধিদিক
কেবলি খুঁজতে থাকি। ফের বাঁশি বাজাবে কি উধাও বিশ্বাস
নিষ্ফলা প্রান্তরে, দগ্ধ বনে, জনশূন্য নদীতীরে,
অসুস্থ শহরে?
অনাহীরী শিশু আর পঙ্গু নারীদের সাদা পাখি নেবে তুলে
চঞ্চুর আশ্রয়? অনাথের ক্ষতি নিরিবিলি ঝরে
নক্ষত্রের আলো, তুমি কপটতা ছেড়ে দূস্থ ভিড়ে
মিশে গিয়ে জেনে নাও জগৎ-সংসার কবিতার
খাতা কিনা। সুখ চাই সুখ চাই বলে সত্তার নিভৃত মূলে
কখনো এনো না ডেকে বিষপিঁপড়ের ঝাঁক; তুমি

দূরত্ব আবৃত্তি করে যখন নিকটে চলে আসো কারো, তার
লতাগুল্মময় মনোভূমি
দুলে ওঠে, সোহাগের সিংহাসনে ব’সে পা দোলানো ভালো লাগে,
ভালো লাগে কবেকার ক্ষতচিহ্নে জ্যোৎস্নাধারা বয়ে
যেতে দেখে অবসরে। হঠাৎ আবার মগজের কোষে জাগে
পদহীন ভিখিরি দল, বন্ধ ঘরে কে এক উন্মাদ ভয়ে
জড়ো-সড়ো কিংবা নোংরা নখে দেয়ালে থেকে রোদ
মুছে ফেলবার জেদে দাঁতে দাঁতে ঘষে। ঘুরে দেখি, ডানপাশে
আর্কাইভ জেগে ওঠে-প্রাচীন দ্রব্যের স্তূপ থেকে
আস্তে একাকিনী নারী, কবে যেন হয়েছিল দেখা, উঠে আসে
ছড়িয়ে স্মৃতির মসলিন; একজন দার্শনিক মূল্যবোধ
বিষয়ে ভাবিত, হাতে তাঁর নষ্ট সভ্যতার ভগ্নাংশ, বিবেকে
প্রভূত পীড়ন, অলিন্দের খোলা হাওয়া চাই বলে
জংধরা চেয়ারের কাছ থেকে বাঁ দিকে দাঁড়ান সরে; কবি
করোটিতে সুরা পান করে খসখসে পাণ্ডুলিপি জ্বলজ্বলে
পাখির মতন দেন ছেড়ে। আর্কাইভে আরো কত মুখচ্ছবি

প্রাচীনতা ভেদ করে ঘাসে ঘাসে, আকাশে আকাশে
কেবলি রটাতে চায় বার্তা, একজন প্রেমিকের
মৃতদেহ গোলাপের গুচ্ছ হয়, ঝরে যায় ক্লান্ত প্রহরের
সঙ্গীত ফুরোলে, হে আমার আপন করুণ বিউগল
বাজো, বেজে ওঠো এ বিশদ সূর্যাস্তের ক্ষণে গভীর আশ্বাসে,
চেয়ে দ্যাখো শতাব্দীর বিদীর্ণ হৃদয় থেকে রক্তবিন্দু ঝরে অবিরল।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 125

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts